Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কোর্টে নালিশ দায়ের, আরাবুল ঘরবন্দি

ভাঙড়ের তৃণমূল কর্মী রমেশ ঘোষালের হত্যাকাণ্ডে আরাবুল ইসলাম-সহ চার জনের বিরুদ্ধে সরাসরি বিচারকের কাছে জবানবন্দি দিলেন নিহতের পরিজনেরা। এর আগে তাঁরা চাইলেও পুলিশ আরাবুলের নামে নালিশ লিখতে দেয়নি বলে অভিযোগ। এখন দল থেকে আরাবুলের বহিষ্কারের পরে আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হলো। এর পর পুলিশ-প্রশাসন আরাবুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় কি না, সেটাই দেখার বলে মনে করছেন বিরোধীরা।

সোনারপুর থানার সামনে নিহত রমেশ ঘোষালের স্ত্রী আশাদেবী (বাঁ দিকে) ও মেয়ে পারমিতা। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র

সোনারপুর থানার সামনে নিহত রমেশ ঘোষালের স্ত্রী আশাদেবী (বাঁ দিকে) ও মেয়ে পারমিতা। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৫৭
Share: Save:

ভাঙড়ের তৃণমূল কর্মী রমেশ ঘোষালের হত্যাকাণ্ডে আরাবুল ইসলাম-সহ চার জনের বিরুদ্ধে সরাসরি বিচারকের কাছে জবানবন্দি দিলেন নিহতের পরিজনেরা। এর আগে তাঁরা চাইলেও পুলিশ আরাবুলের নামে নালিশ লিখতে দেয়নি বলে অভিযোগ। এখন দল থেকে আরাবুলের বহিষ্কারের পরে আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হলো। এর পর পুলিশ-প্রশাসন আরাবুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় কি না, সেটাই দেখার বলে মনে করছেন বিরোধীরা।

পুলিশ ও আদালত সূত্রের খবর, বুধবার বারুইপুর মহকুমা আদালতে বিচারক হিমিকা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আরাবুল ইসলাম, বেঁওতা-১ পঞ্চায়েতের প্রধান সৌমেন নস্কর, ভজ মণ্ডল, শঙ্কর মণ্ডল ওরফে রাজু এবং দীনবন্ধু মণ্ডল নামে চার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন রমেশের পরিবারের লোকজন। অভিযোগকারীদের মধ্যে ছিলেন রমেশের মেয়ে পারমিতা, ভাইঝি লক্ষ্মী, দুই বউদি কল্পনা ও সবিতা। এই চার জন খুনের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। আরাবুলই খুনের মূল চক্রী বলেও তাঁদের দাবি।

শনিবার ঘটনার দিন, কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানা রমেশবাবুর পরিবারকে যথাযথ ভাবে এফআইআর করতে দেয়নি বলে অভিযোগ। রমেশবাবুর স্ত্রী ও কন্যা ও ভাইয়ের অভিযোগ ছিল, থানায় তাঁদের দিয়ে একটি সাদা কাগজে সই করানো হয়েছিল। পরে তাঁরা জানতে পারেন, ওই কাগজে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির হাতে রমেশবাবু খুন হয়েছেন বলে লেখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আরাবুল নিজেই থানায় বসে পুলিশকে চালিত করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল। এ ব্যাপারে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের দাবি, রমেশবাবুর স্ত্রীর অভিযোগে ভিত্তিতেই ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছিল পুলিশ। কিন্তু তদন্তে কয়েক জনের নাম উঠে এসেছে। সে কারণেই বিচারকের কাছে পরিবারের সদস্যেরা ফের অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ বার সেই মতো তদন্ত এগোবে।

ইতিমধ্যে মঙ্গলবার ভাঙড়ের দাপুটে নেতা আরাবুলকে ছ’বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে তৃণমূল। তার পরই এ দিন আরাবুলের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের হওয়ার খবর শুনে তাঁর অনুগামীরা কিছুটা মুষড়ে পড়েছেন। আরাবুলকে গ্রেফতার করা হতে পারে, এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। অন্য দিকে বিরোধীদের বক্তব্য, চাপের মুখে আরাবুলকে বহিষ্কার করা হয়েছে ঠিকই। তবে দল সত্যিই তাঁর ডানা ছাঁটতে আগ্রহী কি না, সেটা বোঝা যাবে পুলিশ-প্রশাসনের মতিগতি দেখেই। আদালতে অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে পুলিশ আরাবুলকে নিয়ে কী করে, সেটাই আসল কথা বলে তাঁদের দাবি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সিপিএম জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “আরাবুলকে এখনও পঞ্চায়েত সমিতি থেকে সরানো হয়নি। পুলিশও তাঁকে গ্রেফতার করেনি। আরাবুলের পৃষ্ঠপোষকরাও বহাল তবিয়তেই আছেন।”

২৫ অক্টোবর, ভাইফোঁটার দিন সকালে ভাঙড়ের বেঁওতা-১ গ্রামে নিজের বাড়িতে দুষ্কৃতীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন রমেশ। রমেশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুষ্কৃতীরা প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান সত্যজিত্‌ মণ্ডল ওরফে পাঁচুর বাড়িতে হামলা চালায়। সে সময়ে দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল বাপন মণ্ডল নামে আরও এক তৃণমূল কর্মীর। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে কোনও মতে পালিয়ে বাঁচেন পাঁচু। ওই দিনই বাপনের মা চৈতালিকে আরাবুল-অনুগামীরা গাড়িতে চাপিয়ে থানায় নিয়ে আসেন। অভিযোগ, পাঁচু ও তাঁর দুই ছেলের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করার জন্য চৈতালিদেবীকে হুমকি দেন আরাবুল। তাঁকে দিয়েও সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয়। চৈতালিদেবী পরে বলেন, “আরাবুলের চাপে সাদা কাগজে সই করে দিয়েছিলাম। ওরা পাঁচু ও তাঁর দুই ছেলের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছিল।”

এ দিন অবশ্য আরাবুলের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তিনি বাড়িতে নেই বলে জানানো হয়েছে। তাঁর দু’টি মোবাইলও সকাল থেকেই বন্ধ ছিল। তা হলে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরের দিনটি কী ভাবে কাটালেন আরাবুল?

আরাবুলের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার ভোর রাতে বাড়ি ফিরে দরজায় খিল এঁটেছেন ভাঙড়ের ‘তাজা নেতা’। অনুগামীরা গাজিপুরে তাঁর বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু আরাবুল বাইরে আসেননি। তবে পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সাত সকালে কয়েক জন অতি-ঘনিষ্ঠ অনুগামী আরাবুলের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁদের এক জন বলেন, “দাদা নিজের ঘরেই রয়েছেন। কখনও বিছানায় আধ-শোয়া, তো কখনও সোফায় বসে কাছের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। কিছুটা বিচলিত দেখাচ্ছে তাঁকে।” আরাবুলের এক সঙ্গীর কথায়, “দাদা বলছেন, অপেক্ষা করতে হবে। ওয়েট অ্যান্ড সি। দল আমাকে নিয়ে সত্যি কী ভাবছে, তা আগে জানা দরকার।” আর এক অনুগামীর কথায়, “এখনও পর্যন্ত সরকারি ভাবে দাদাকে বহিষ্কারের নির্দেশ ধরানো হয়নি। সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে এবং তৃণমূলের মহাসচিব সংবাদমাধ্যমকে যা বলছেন, ওইটুকুই দাদা-র কাছে খবর।”

তবে এ দিন দলের রাজ্য স্তরের কয়েক জন নেতার সঙ্গে আরাবুলের মোবাইলে কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই অনুগামী। সকাল থেকে বেশ কয়েক বার ওই অনুগামীদের ফোন করে পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছেন তাঁরা। তবে কোনও নেতাকে আরাবুলের বাড়িতে দেখা যায়নি।

আরাবুলের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ বন্ধ ঘরে তাঁরই এক সঙ্গীর মোবাইলে খবর আসে, ঘটকপুকুর মোড়ে আরাবুলের বহিষ্কারের প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই আর এক অনুগামীকে মোটরবাইক নিয়ে সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন আরাবুল। বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। সেই মতো কাজও হয়। তার পর দুপুরে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে ফের রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি। ওই ঘনিষ্ঠদেরই এক জন বললেন, “দাদা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দাদা বলছেন, ২০০৬ সাল থেকে দলের সব বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ভাঙড়ে সিপিএমের সঙ্গে একা লড়াই করেছি। বহু বড় নেতাকে নানা সাহায্য করেছি। এখন আমাকে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে।”

কিন্তু আরাবুলকে বহিষ্কার না-করে যে উপায় ছিল না, তা এ দিন কবুল করেছেন তৃণমূলের বহু নেতাই। এখন ব্যবস্থা না নিলে দলকে পরে আরও বড় মাসুল দিতে হতো বলে তাঁদের অভিমত। কারণ, শীর্ষ নেতাদের একাংশের প্রশ্রয়ে আরাবুলরা ক্রমশ দলের ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছিলেন বলে তাঁরা মনে করেন। ওই নেতাদের বক্তব্য যে উড়িয়ে দেওয়ার নয় তা এ দিন দলের মহাসচিবের কথাতেও স্পষ্ট হয়েছে। আরাবুলের শাস্তি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “বৃহত্তর স্বার্থেই আরাবুলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।’’ তাঁর ব্যাখ্যায়, “আরাবুলদের কাজে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছিল। আরও যে সমস্ত নেতা বা কর্মী নিজেদের দলের উপরে বলে ভাবতে শুরু করেছেন, এতে তাঁদেরও একটা বার্তা দেওয়া হল।”

এত দিন ভাঙড়ে তৃণমূলের সর্বেসর্বা ছিলেন আরাবুল। তাঁকে, তাঁর অনুগামী জাহাঙ্গির খান চৌধুরীকে বহিষ্কার এবং ভাঙড় ১ নম্বর ব্লকের নেতা কাইজার আহমেদকে দলীয় পদ থেকে সরানোর পরে সেখানে নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলা কী করে করা হবে? এর উত্তরে পার্থবাবু জানিয়েছেন, আপাতত রাজ্য নেতৃত্বই ভাঙড়ের সাংগঠনিক বিষয় দেখবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE