সমবেদনা: কালিকাপ্রসাদের স্ত্রীর পাশে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
ডেনমার্কে বসে খবরটা পেলাম। হলস্টেব্রো শহরে এসেছি। সকালে উঠে মোবাইলের দিকে তাকাতেই পরপর বার্তাগুলো ভেসে উঠল।
অবিশ্বাস্য। এ কী করে হয়?
এই তো সেদিন দেখা হল। সেই মানুষটা নেই? ১ মার্চ সকালে কলকাতা বিমানবন্দরে বসে বসে ঢুলছিলাম। সিলেটে গান গাইতে যাব। বোর্ডিং শুরু হতে যেই গেটের দিকে এগিয়েছি, পিছন থেকে চেনা গলার ডাক! কালিকাদা! ‘‘তুমিও ঢাকা যাচ্ছ?’’ কালিকাদা বলল, ‘‘হ্যাঁ। ‘ভুবন মাঝি’র (ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় তৈরি ছবি) সিডি প্রকাশ হবে।’’ বলল, ‘‘আরে তুমি আছ আগে জানলে...।’’ সত্যি তো! কত ক্ষণ তো বসে ঢুলছিলাম। আগে জানলে কালিকাদার সঙ্গে গল্প করা যেত।
বিমানে কালিকাদার সিট আগের দিকে। কালিকাদা বলল, ‘‘আমি তোমায় এসে দেখে যাব। ঢাকা পৌঁছে গেলে কোথায় ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে!’’ মনে মনে ভাবলাম, আধ ঘণ্টার তো পথ। এর মধ্যে কালিকাদা কী করে আসবে? ওমা! বিমান ঢাকার মাটি ছোঁয়ার আগে দেখি ঠিক আমার আসনের পাশে দাঁড়িয়ে!
কালিকাদা এই রকমই। স্নেহময় আর দায়িত্বশীল। এক বার শিলচরে কালিকাদার বাড়ি গিয়েছিলাম। ওঁদের যৌথ পরিবার। মনে হয়, সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষমতাটা কালিকাদা সেখান থেকেই পেয়েছিলেন। শিলচরের সংস্কৃতি চর্চায় ওই পরিবারের অবদান একেবারে প্রথম সারিতে। কালিকাদা তাই অন্য সবার থেকে আলাদা। গ্রামেগঞ্জে যাঁরা গানের পরম্পরাকে ধরে রেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে বসতেন। খবর রাখতেন, তাঁদের কথা ভাবতেন। বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করতেন, তা নিয়ে পড়াশুনো করতেন।
একবার গুয়াহাটিতে গান গাইতে গেছি। কালিকাদাই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে আমার পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘পার্বতীর গানে আমার ঈশ্বরদর্শন হয়।’’ এটা আমার জীবনে অনেক
বড় প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন: ওর কাজটা আর শেষ হল না
আজ সেই মানুষটার কথা লিখতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না। দূরে বসে খালি কাতরাচ্ছি, আর ছটফট করছি। সিলেটে অনুষ্ঠানের আগে কালিকাদা লিখলেন, ‘‘আমার চেনা জায়গায় তুমি গান গাইতে গেলে মনে হয় আমি-ই গাইতে গেছি।’’ আমি উত্তরে লিখলাম, ‘‘এখন ভাবছি তোমাকে ঢাকা থেকে তুলে নিলেই ভাল হতো!’’ ৪ মার্চ রাতে কলকাতায় পৌঁছে আমরা একসঙ্গে অনেক রাত অবধি কাটালাম। কালিকাদা গোটা বাংলার সঙ্গীতকে, বাঙালিদের গানকে এক জায়গায় আনার চেষ্টা করছিলেন একটি ওয়েব পোর্টালে। সেই রাতে তার জন্য আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। বললেন, ‘‘তোমারটাই প্রথম!’’
কালিকাদা বাংলার বহু লোকশিল্পীর জীবনে আশার সূর্য হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। তিনি যে রাস্তাটা তৈরি করে দিয়ে গেলেন, সেটা উত্তরসূরিরা এগিয়ে নিয়ে চলুন— এই আমার প্রার্থনা। কালিকাদা রক্তমাংসে না থাকলেও সকলের মনে প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন। গানেই তো আছে, প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে...। কালিকাদাও তা-ই থাকবেন।
অনুলিখন: পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy