Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ক্ষমা চাইলেই কি সব অপরাধ মাফ, জানতে চাইল আদালত

স্রেফ ক্ষমা প্রার্থনা করেই কোনও অপরাধের দায়িত্ব ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় কি না, সেই প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাইকোর্ট। প্রসঙ্গ: কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের বিতর্কিত ও ‘প্ররোচনামূলক’ মন্তব্য, এবং তা নিয়ে ঝড় ওঠার পরে সাংসদের দুঃখপ্রকাশ। বুধবার তাপসবাবুর কৌঁসুলির কাছে হাইকোর্ট জানতে চেয়েছে, ক্ষমা চাইলেই কি সব মিটে যায়?

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৪ ০৩:১০
Share: Save:

স্রেফ ক্ষমা প্রার্থনা করেই কোনও অপরাধের দায়িত্ব ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় কি না, সেই প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাইকোর্ট। প্রসঙ্গ: কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের বিতর্কিত ও ‘প্ররোচনামূলক’ মন্তব্য, এবং তা নিয়ে ঝড় ওঠার পরে সাংসদের দুঃখপ্রকাশ। বুধবার তাপসবাবুর কৌঁসুলির কাছে হাইকোর্ট জানতে চেয়েছে, ক্ষমা চাইলেই কি সব মিটে যায়?

গত ১৪ জুন নিজের লোকসভা কেন্দ্র এলাকায় পাঁচটি সভায় তাপসবাবুর বক্তৃতা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ওঠে। অভিযোগ: সাংসদের বক্তব্য চূড়ান্ত উস্কানিমূলক এবং তা দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে। তাপসবাবুর নামে এফআইআর দায়ের হয় বিভিন্ন থানায়। তার পরেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা না-নেওয়ায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে হাইকোর্টে মামলা করেন জনৈক বিপ্লব চৌধুরী।

বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে এ দিন তারই শুনানি ছিল। সওয়াল করতে উঠে তাপস পালের কৌঁসুলি রাজদীপ মজুমদার বলেন, “এমপি খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন ঠিকই। তবে সে জন্য তিনি সংবাদমাধ্যম মারফত ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন।” রাজদীপবাবুর যুক্তি: আগের দিন ওই অঞ্চলে এক জন খুন হওয়ার কারণেই তাপসবাবু অত্যন্ত ‘আবেগমথিত’ হয়ে এমন সব উক্তি করেছেন।

বিবাদী কৌঁসুলির যুক্তি শুনে বিচারপতি জানতে চান, “সাংসদ কার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন? কোথায় ক্ষমা চেয়েছেন? কেউ এক জন ধর্ষণ করল, আর তার পরে ক্ষমা চেয়ে নিল সেটাই কি শেষ কথা?” বিচারপতি দত্তের আরও পর্যবেক্ষণ, “যিনি মন্তব্যগুলি করেছেন, তিনি এক জন আইন প্রণেতা। লোফার নন। সব কিছুরই একটা সীমা থাকে!”

রাজদীপবাবুর পথে হেঁটে সরকারপক্ষের কৌঁসুলি মনজিৎ সিংহও এ দিন দাবি করেন, তাপসবাবুর ১৪ জুনের বক্তৃতায় অপরাধমূলক উস্কানি কিছু নেই। বিচারপতি দত্ত তাঁদের বক্তব্যে সন্তুষ্ট না-হয়ে এজলাসে উপস্থিত জিপি (গভর্নমেন্ট প্লিডার) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে আহ্বান জানান, “আপনার পাবলিক প্রসিকিউটর বলছেন, এমন কথা বলা অপরাধ নয়। আসুন, আমরা বক্তৃতাটির সিডি দেখি।”

জিপি উত্তর দেন, “মামলার আবেদনকারী গোড়া থেকেই বলছেন,তিনি টিভি দেখে আর খবরের কাগজ পড়ে সাংসদ সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেছেন।” বিচারপতির পাল্টা জবাব, “আবেদনকারী পুলিশকে সেই তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু আমি যদি কিছু দেখি ও পুলিশকে জানাই, তা কি তথ্যপ্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে না? তথ্যপ্রমাণ আইন দেখুন!’’ জবাবের অপেক্ষা না-করে বিচারপতির প্রশ্ন, “মাননীয় জিপি, আপনি যদি মনে করেন আপনার সরকার ভুল পথে চলছে, সরকারকে ঠিক পরামর্শ দেবেন না?”

কেন তিনি সিডি দেখবেন না, জিপি-র কাছে ব্যাখ্যা চায় আদালত। বিচারপতি বলেন, “প্রথম দিন থেকে আপনার কাছে জানতে চাইছি, এই ঘটনায় সরকারের ভূমিকা কী? সাংসদ এমন কথা বলেছেন কি না। হ্যাঁ বা না-তে বলুন। বলুন, সরকারের এ নিয়ে কী বলার আছে। এখনই বলুন।” জিপি-র জবাব, “এক জন আইনজীবী হিসেবে কী ভাবে ঝুঁকি নিয়ে বলি, উনি বলেছেন নাকি বলেননি? আমি তাপস পালের কৌঁসুলি নই। আমি সরকারের আইনজীবী।”

বিচারপতি সরকারি কৌঁসুলির কাছে জানতে চান, “আপনি ওই সিডি দেখেছেন?” সরকারি কৌঁসুলি জানান, দেখেননি। “এখন আপনার সঙ্গে বসে সিডি দেখব,” বলেন বিচারপতি দত্ত। কোর্ট অফিসারকে বিচারপতি নির্দেশ দেন ল্যাপটপে সিডিটি চালাতে। ১৪ জুন নাকাশিপাড়ার চৌমুহায় তাপসের দেওয়া সেই বক্তৃতা ফের বেজে ওঠে এজলাসে ‘আমি প্রচুর মাস্তানি করেছি। একটা কেউ বিরোধী মাস্তানি করতে আসুক, আমাদের ছেলেদের ঢুকিয়ে রেপ করে দেব.....।’

সিডি শোনা শেষ হয়। তাপসবাবুর কৌঁসুলিকে বিচারপতি বলেন, “এ বার বলুন, আপনার কী বলার আছে।” রাজদীপবাবু উত্তর দেন, “আমার মনে হয় না, এটা তদন্তগ্রাহ্য অপরাধ।” বাদীপক্ষের কী অভিমত?

আবেদনকারীর কৌঁসুলি অনিরুদ্ধ চট্টোপাধ্যায় জানান, “সাংসদের এ হেন বক্তব্য সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ দাখিল হয়েছে। তাঁর বক্তৃতা সিডিবন্দি করে রাজ্য পুলিশের ডিজি, স্বরাষ্ট্র-সচিব, জেলার এসপি, থানার ওসি ও নির্বাচন কমিশনে রেজিস্ট্রি পোস্টে পাঠানো হয়েছে। তবু পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি! বোধহয় নেবেও না!” অনিরুদ্ধবাবুর আক্ষেপ, “সাংসদ ক্ষমা চেয়েছেন। তার মানে, তিনি দোষের কথা কবুল করছেন! আমরা সিবিআই-তদন্ত চাইনি। কিন্তু পুলিশ তো তদন্ত করতে পারত! বেআইনি জমায়েত, মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষের আশঙ্কা ইত্যাদি ধারায় অভিযুক্ত করতে পারত তাপস পালকে। কিছুই করেনি!”

সরকারপক্ষ কী মনে করছে?

সরকারি কৌঁসুলি মনজিৎ সিংহের দাবি, “তাপস পাল কোনও অপরাধ করেননি। করার কোনও ইচ্ছে তাঁর ছিল না। ওই সব কাজের প্রস্তুতি তিনি নেননি। ওঁর বক্তব্য আদালতগ্রাহ্য অপরাধ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” শুনে বিচারপতির প্রশ্ন, “দুই গোষ্ঠীতে শত্রুতা তৈরি করা কিংবা তৈরির চেষ্টার অভিযোগে সাংসদের বিরুদ্ধে কেন মামলা দায়ের করা যাবে না?” সরকারি কৌঁসুলির ব্যাখ্যা, “গত ১৪ জুন ওই বক্তব্য প্রচার হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে এখনও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।” বিচারপতি তাপসবাবুর কৌঁসুলিকে জিজ্ঞাসা করেন, “সাংসদ ওই বক্তৃতা দিয়েছিলেন কবে?” রাজদীপবাবু জানান, “ভোটের আগে। রাজনৈতিক প্রচারসভায় গিয়ে তিনি কথাগুলো বলেন।” এরই মধ্যে জিপি অশোকবাবু অভিমত দেন, “এখন অনেকেই সাংসদ হচ্ছেন। ফুলন দেবী যখন এমপি হন, তখন ব্যথিত হয়েছিলাম। তবে মামলাটি জনস্বার্থ-মামলা হিসেবে দায়ের হতে পারে।”

আদালত একমত হতে পারেনি। ‘‘মাননীয় জিপি, আপনি এখন ‘ইউ টার্ন’ করছেন!” মন্তব্য করেন বিচারপতি। জিপি’কে বলেন, “আপনাকে মনে করাই, আগের দিন আপনি বলেছেন, এমপি’র বক্তব্যের প্রেক্ষিতে দায়ের হওয়া প্রথম মামলাটি গ্রাহ্য হবে না, কারণ পুলিশে কেউ অভিযোগ করেনি। আর আজ যখন পুলিশে নালিশ করার কথা প্রকাশ পাচ্ছে, তখন অন্য কথা বলছেন!” জিপি-র উদ্দেশে বিচারপতির বার্তা, ‘‘পেশার গোড়ায় আমরা শিখেছি, মক্কেল ও আদালতের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে। আপনি গভর্নমেন্ট প্লিডার। নাগরিকদের স্বার্থ দেখা আপনার কর্তব্য।” পাশাপাশি সরকারি কৌঁসুলিকে কার্যত ভর্ৎসনা করে বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘আপনাকে আগেই বলেছিলাম, আইনমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য থানার আইসি (ইন্সপেক্টর ইন চার্জ)-কে নির্দেশ দিতে। আপনি নির্দেশ দেননি!’’

শুনানি শেষ হলেও মামলার রায় এ দিন ঘোষণা করেননি বিচারপতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tapas pal hate speech high court apology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE