Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অশোক মডেলে ফের বাজিমাত, বাম দখলে গ্রাম শিলিগুড়িও

পরপর দু’বার প্রবল প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে ডার্বি ম্যাচে জয়! বাম মহলে বুধবার বিকেল থেকেই নতুন নাম চালু হয়ে গেল শিলিগুড়ির মেয়রের। ‘সিপিএমের অশোক স্তম্ভ’!

জয়ের উচ্ছ্বাস। কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে অশোক ভট্টাচার্য। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

জয়ের উচ্ছ্বাস। কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে অশোক ভট্টাচার্য। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

পরপর দু’বার প্রবল প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে ডার্বি ম্যাচে জয়! বাম মহলে বুধবার বিকেল থেকেই নতুন নাম চালু হয়ে গেল শিলিগুড়ির মেয়রের। ‘সিপিএমের অশোক স্তম্ভ’!

প্রথমে শহর এবং এ বার গ্রাম। সম্মিলিত প্রতিরোধের পথে তৃণমূলকে দু-দু’বার রুখে দিয়ে গোটা শিলিগুড়ির জন্য আলাদা সম্ভ্রম আদায় করে নিলেন অশোক ভট্টাচার্য। সঙ্গে দার্জিলিং জেলা সিপিএমের সম্পাদক জীবেশ সরকার। তাঁদের এই লড়াইয়ের সফল রসায়নের সুবাদেই রাজ্য রাজনীতিতে আরও জাঁকিয়ে বসল ‘শিলিগুড়ি মডেল’। বিধানসভা নির্বাচন আর কয়েক মাস দূরে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের প্রবল পরাক্রমের মোকাবিলা করতে শিলিগুড়ির পথের বিশ্বাসযোগ্যতা বহু গুণে বাড়িয়ে তুললেন অশোকবাবুরা। উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিধানসভার ৭৬টি আসন। সেই সব আসনে তৃণমূলকে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাতে এখন থেকেই তৈরি হচ্ছেন অশোকবাবুরা। আর সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা চেষ্টা চালাবেন শিলিগুড়ির প্রতিরোধকে এ বার দক্ষিণবঙ্গেও নামিয়ে আনতে।

রাজ্য জুড়ে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত মিলে তিনশোরও বেশি আসনে উপনির্বাচন হয়েছিল শনিবার। তার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই ঘরে তুলেছে তৃণমূল। উপনির্বাচনে শাসক দলের সাফল্যই দস্তুর। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নির্বাচনই ছিল মর্যাদার লড়াই। ছ’বছর আগে মহকুমা পরিষদ পেয়েছিল বামেরাই। এ বার মোট ৯ আসনের মহকুমা পরিষদে বামেরা পেয়েছে ৬টি আসন, বাকি তিনটি তৃণমূলের। তবে এখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অশোকবাবুদের এ বারের সাফল্যের তাৎপর্য আলাদা। যে সাফল্য বিশ্লেষণ করে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলছেন, ‘‘নিজের ভোট মানুষ নিজে দিতে পারলে কী হতে পারে, বোঝা যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে ধাপ্পা শিলিগুড়ির মানুষ ধরে ফেলেছেন। অন্যত্রও নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারলে মানুষ তৃণমূলকে জবাব দেবেন!’’ বিমানবাবুরা বিলক্ষণ জানেন, গণনার তারিখ যে দিনই হোক, বিধাননগর, আসানসোল ও বালি পুর-এলাকার ভোটের বাক্স খুললে তাঁদের জন্য বলার মতো কিছু থাকবে না। সেখানে তৃণমূল যেমন দাপিয়ে মেরে-ধরে ভোট করেছে, তেমনই বিরোধীরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তৃণমূল স্তরে সব বিরোধী দলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে যা পরপর দু’বার করে দেখিয়েছেন অশোক-জীবেশ। সেই জন্যই আরও বেশি করে শিলিগুড়িকে আঁকড়ে ধরছেন বিমানবাবুরা।

তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের সামগ্রিক ফলাফল নিয়ে প্রকাশ্যে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ভুটান সফররত মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘নির্বাচনের যা ফল হয়েছে, তাতে আমরা খুশি। আমাদের আসন ও ভোট, দু’টোই বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাশার চেয়ে ভালই হয়েছে। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ তো আমাদের ছিল না! সেখানে আমাদের ভোট বেড়েছে, আসন বেড়েছে।’’

বস্তুত, এই ভোট ও আসন বৃদ্ধির তত্ত্ব দিয়েই শিলিগুড়ির অস্বস্তি চাপা দিতে আসরে নেমেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় যেমন মেনে নিয়েছেন, ‘‘অন্যান্য জায়গার মতো শিলিগুড়িতে ফল করতে পারিনি। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে ওখানে ভোট করতে হয়েছে। তবে ওখানে ভোট বেড়েছে আমাদের।’’ উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের সংযোজন, ‘‘হ্যাঁ, বিরোধীরা ওয়ান-টু-ওয়ান লড়লে দেখতাম! যাই হোক, আমাদের ফল আগের পঞ্চায়েত ভোটের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে।’’ একই সঙ্গে সুব্রতবাবুর আক্রমণ, শিলিগুড়িতে বামেরা ‘নিম্ন মানের ও অনৈতিক প্রচার’ করে জিতেছে! পঞ্চায়েতমন্ত্রীর দাবি, ‘‘অশোকবাবুরা ওখানে বলেছ‌েন, আমাদের ভোট দিন। না হলে কংগ্রেসকে দিন। যদি মনে করেন কংগ্রেসও জিতবে না, তা হলে বিজেপি’কে দিন। এই অনৈতিক প্রচারে মানুষ কোথাও কোথাও বিভ্রান্ত হয়েছেন!’’ যার জবাবে বিমানবাবু আবার বলেছেন, ‘‘গরিব মানুষ একজোট হয়ে বামফ্রন্টকে ভোটদিয়েছেন। এর মধ্যে কীসের অনৈতিক!’’

প্রতিরোধ গড়তে সব বিরোধীকে এককাট্টা করার অশোক-সূত্র কার্যকর হওয়া মানে সহজ অঙ্কেই তৃণমূলের বিপদ। ভবিষ্যতের জন্য সেই বিপদ আঁচ করেই পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ সুব্রতবাবু প্রকাশ্যে শিলিগুড়ি মডেলকে গুরুত্বই দিতে চাননি। তাঁর তির্যক মন্তব্য, ‘‘রাজনীতিতে মডেল বলে কিছু হয় না। রাস্তায়-র‌্যাম্পে যারা হাঁটে, সিনেমায় মডেল হয়!’’

বাইরে এমন কটাক্ষ হলেও তৃণমূলের অন্দরের খবর, শিলিগুড়ি পুরভোটে হারকে ‘অন্তর্ঘাত’ বলে মনে করে শাসক দলের অনেকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাননি। কিন্তু মহকুমা পরিষদের ফল অনেকের বুকেই কাঁপুনি ধরিয়েছে! কারণ, শিলিগুড়িতে বামেরা চারটি পঞ্চায়েত সমিতির দু’টি ও ২২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৭টি একক ভাবেই দখল করেছে। একটি পঞ্চায়েত সমিতি নির্দলকে ও আর একটি কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে দখলের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছে তারা। কংগ্রেস ও নির্দলকে নিয়ে আরও অন্তত ৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখলের চেষ্টাও হবে বলে বাম সূত্রের দাবি।

শাসক ও বিরোধী দুই শিবিরই জানে, শহুরে এলাকায় ভোটের দিন ও গণনার সময়ে বিরোধীদের একজোট করা যতটা সহজ, গ্রামে ততটা নয়। সেটা বুঝে পুরভোটের পরেই গ্রামে মন দিয়েছিলেন অশোকবাবুরা। সকালের দিকটা কোনও মতে পুরসভায় গিয়ে দুপুর গড়াতেই গ্রামের মেঠো পথে চক্কর খেতেন মেয়র তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী। কোথাও কোনও বিরোধী দলের কেউ আক্রান্ত হলেই ওই জুটি পালা করে সকালে-বিকেলে গিয়ে গরমাগরম বিবৃতি দিয়েছেন। কোথাও সিপিএম কর্মীর উপরে হামলা হলে ঘটনাস্থলে পৌঁছে হইচই বাধিয়েছেন। গভীর রাতে কোথাও দলীয় কার্যালয় ভাঙার খবর পেলেও নিজেরা ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে কার্যালয় তৈরি করিয়েছেন।

তৃণমূলের মধ্যে মন্ত্রী গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে, সেটাও কাজে লাগাতে ছাড়েননি বামেরা। ভোটের ক’দিন আগে মেয়র নিজের দফতরে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতার সঙ্গেও ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ করেছেন। শিলিগুড়িতে কান পাতলেই শোনা যায়, গত চার বছরে প্রায় সব বিরোধী দলের প্রথম সারির নেতাদের ‘সুখ-দুঃখের খবরাখবর’ নিতে ঘনঘন ফোন করেছেন অশোক-জীবেশ। গৌতমবাবুরা পরিষদের প্রচারে নামার মাসচারেক আগে থেকেই গ্রামে ঘুরে যেখানে যাঁর জেতার সম্ভাবনা, সেখানে তাঁকে জয়ী করতে ‘জোট বাঁধা’র পক্ষে লাগাতার সওয়াল করেছেন ওই জুটি। তাতে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে কংগ্রেস দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান ধরে রাখতে পেরেছে। তেমনই মহকুমা পরিষদে বামেদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা যে জোরদার, এই প্রচার সামনে রেখে আগের চেয়ে আসন বাড়িয়ে তৃণমূলকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন।

এ হেন জয়ের পরে কিন্তু বিজয় মিছিলের পথে এ দিন হাঁটেননি দুই নেতা। বরং, যে এলাকায় প্রার্থীরা হেরেছেন, সেখানে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরাজিত কংগ্রেস, নির্দল, বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাকে সান্ত্বনা দিতেও গাড়ি ছুটিয়েছেন মাটিগাড়া, বাগডোগরা, নকশালবাড়িতে। এত সতর্কতা কেন? অশোকবাবুর জবাব, ‘‘পরিষদ বোর্ড গঠন না হওয়া পর্যন্ত প্রতি পদে হেনস্থার চেষ্টা হবে। এখন ঢিলে দিলে চলবে না! আরও এককাট্টা হয়ে থাকতে হবে। যাতে শাসক দল দাঁত ফোটাতে ভয় পায়। তাই গ্রামে গ্রামে ঘুরছি।’’ জীবেশবাবুর সংযোজন, ‘‘পুরসভা, মহকুমা পরিষদের পরে এখন সামনে বিধানসভা। আরও সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে বিরোধীদের থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। তা হলে কারও কোনও জারিজুরি খাটবে না।’’

বিরোধীদের পাশে নেওয়ার যুক্তিরই প্রতিধ্বনি করে দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়া বলেছেন, ‘‘আমরা যদি বিধাননগর বা আসানসোলের মতো তৃণমূলের বিরুদ্ধে একা লড়তাম, তবে শিলিগুড়িতেও তেমনই ফল হতো! কিন্তু আমরা চেয়েছি যাতে বাসিন্দারা সকলে নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারেন। তাই শিলিগুড়িতে বুথ স্তরে সকলে মিলে তৃণমূলকে ঠেকিয়েছি।’’ দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস (সমতল) সভাপতি শঙ্কর মালাকারের সুর অবশ্য একটু ভিন্ন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল তো শুধু কংগ্রেসকেই শেষ করতে চেয়েছে। তার পরিণাম যা হওয়ার হয়েছে!’’

দিনের শেষে স্বস্তির হাসি অশোকবাবুর। বলছেন, ‘‘প্রথমে শিলিগুড়ি শহর, তার পরে গ্রাম প্রমাণ করে দিল, তৃণমূলকে হারানো যায়। গুন্ডামি শেষ কথা বলে না!’’ সাধে কি সিপিএমের অন্দরে কেউ কেউ বলছেন, কিছু দিনের জন্য অন্তত দলের সদর দফতরটা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বদলে ‘অশোক স্তম্ভে’র ঠিকানায় পাঠালে কেমন হয়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE