Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আমার পড়শি

চালকলের কাঠ, লোহায় তৈরি মঞ্চ

আমার পড়শিদের অনেককেই চিনেছি মহলার মঞ্চে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জমিদার গিন্নি থেকে রিকশাওয়ালা—সমাজের নানা স্তরের মানুষ। তখন সবে মাত্র কলকাতা থেকে বালুরঘাটে ফিরেছি, পাড়ারই ১৮-১৯ জন মিলে ঠিক করলাম, জোট বেঁধে একটা থিয়েটারের দল গড়তেই হবে।

হরিমাধব মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০৩:১০
Share: Save:

আমার পড়শিদের অনেককেই চিনেছি মহলার মঞ্চে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জমিদার গিন্নি থেকে রিকশাওয়ালা—সমাজের নানা স্তরের মানুষ।

তখন সবে মাত্র কলকাতা থেকে বালুরঘাটে ফিরেছি, পাড়ারই ১৮-১৯ জন মিলে ঠিক করলাম, জোট বেঁধে একটা থিয়েটারের দল গড়তেই হবে। এ দিকে হাত ফাঁকা, নেই জমি-জায়গাও। আমার একটা কলেজের চাকরি থাকলেও বাকিরা সকলেই প্রায় কর্মহীন। তখন পতিরামের জমিদারপত্নীর কাছে গেলাম জমি চাইতে। তিনি বললেন, ‘‘তিন বছর যদি ঝগড়া করে না থাকতে পারো, তা হলেই পাকাপাকি ভাবে ওই জমি দেব।’’ ওঁর ওই জমিতেই শুরু করলাম মুক্তাঙ্গন। ১৯৬৯ সালে শুরু হল ‘ত্রিতীর্থ’র পথ চলা।

আর আমাদের দলেই অমূল্য ছিল রিকশাওয়ালা। গানের ব্যাকরণ এক অক্ষরও জানত না। অথচ অপূর্ব বাঁশি বাজাত, তাল পাতার দিশি সানাই, ঢাক বাজাত। ও আমাদের সঙ্গে ‘দেবাংশী’, ‘দেবীগর্জন’ করত। এত সাধারণ মানুষের মধ্যে এত অতুলনীয় প্রতিভা দেখেছি, গোটা জীবন, যে বলার নয়।

বালুরঘাট তো বলতে গেলে নাটকের পীঠস্থান। ফলে স্কুল ফাইনাল পাশ করার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় খালি নাটক দেখে বেড়িয়েছি। সে সব দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল এটাই যেন আমি পারি। কেউ আমাকে জোর করেনি। খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজটা বেছে নিয়েছিলাম। আরেকটু বড় হয়ে যখন কলকাতায় কলেজে পড়তে যাই এবং চাকরি শুরু করি, তখন নাটক দেখার পরিধিটা আরও অনেক বেড়ে গেল। শুরু হল নতুন ধরনের থিয়েটার দেখা। মফস্সলের চেয়ে অনেক ভিন্ন স্বাদের সে সব নাটক। অজিতেশবাবু, শম্ভুবাবু, কুমারবাবুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা সুযোগ হল। মনোজ, বিভাস, অরুণ তো ছিল বন্ধুস্থানীয়।

বালুরঘাটে ফিরে দল গড়ার সময়ে মঞ্চের জন্য বাঁশ কেনারও পয়সা ছিল না। গ্রামের মানুষের সাহায্যেই নদীতে বাঁশ ভাসিয়ে নিয়ে আসা হল। দারুণ বর্ণময় সামিয়ানা তৈরি হল। শুধু অনুষ্ঠানের দিন তা টাঙানো হতো। পড়শিদের বাড়ির চেয়ার-বেঞ্চ এনে অনুষ্ঠান করতাম। অনুষ্ঠানের দিন এক আইনজীবী পড়শি ঘর ছেড়ে দিতেন মেকআপের জন্য। পাড়ার স্কুলে ছুটির দিন দেখে শনি-রবিবার শো হতো। স্কুলের প্রধান শিক্ষকমশাইয়ের অনুমতি ছিল প্রয়োজনে স্কুলের বেঞ্চ নিয়ে যাওয়ার। একটাই শর্তে। রোববার রাতে আমাদেরই সে সব যথাস্থানে ফিরিয়ে দিতে হবে।

একে মুক্তাঙ্গন সে সময়ে এলাকায় নতুন জিনিস। ফলে ১-২ টাকা টিকিটে থিয়েটার দেখতে প্রচুর দর্শক হতো। ‘ভাঙা পট’, ‘তিন বিজ্ঞানী’ এ রকম অনেক নাটক করেছি সে সময়ে।

হঠাৎ এক দিন পেলাম, হিলিতে একটা চালকল নিলামে উঠছে। মালিককে অনুরোধ করলাম, চালকল নিলামে কেনার তো আমাদের সামর্থ্য নেই, যদি তিনি এমনিই তাঁর যন্ত্রপাতি আমাদের দিয়ে দেন। তা হলে আমরা একটা থিয়েটার গড়তে পারি। উনিও রাজি হয়ে গেলেন। চালকলের কাঠ, লোহা নিয়ে এসে ইঁট গেঁথে নিজেরাই মঞ্চ তৈরি করলাম। ১৯৭৬ সালের পরে মুক্তাঙ্গন ছেড়ে আমরা সেখানেই অভিনয় শুরু করি। পরে টিকিটের পয়সাতেই তার পরিকাঠামো ক্রমে উন্নত করতে থাকি। সেখানেই এখনও ওয়ার্কশপ, অনুষ্ঠান সবই হয়। মহড়ার সময়ে কত আওয়াজ হয়, কিন্তু পড়শিরা কখনওই আপত্তি জানাননি আমাদের কাজে। এ বার আমাদের ২৫ বছর পূর্তি।

বছর তিনেক আগে স্যালারি গ্রান্টের জন্য আবেদন করি। সেটা দিয়েই আপাতত চলছে। হাউসটা যেহেতু আছে, তাই চলে যায়। ১৯৭৮ সালে প্রথম ‘গ্যালিলিও’ করি। ৪৫-৫০টা নাটক করেছি। আশাপূর্ণা থেকে ব্রেশট। এখন ৭৪ বছর বয়স হল। থিয়েটার করে চলেছি। এ বার অমৃতলাল বসুর দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘ব্যাপিকা বিদায়’ করছি।

পা়ড়ায় সকলে আমাকে ‘মাধব’ বলেই ডাকত। প্রণব, নির্মলেন্দু, আমরা মাঠে ঘাটে চৌকি ফেলে দিদিদের শাড়ি নিয়ে থিয়েটার করতাম। সব সময় পাড়ার সকলে বিনা শর্তে সাহায্য করে গিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই আর এখন নেই। আমাদের মঞ্চে বিজনদা এসেছেন, আরও কত কে। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত ছাড়া প্রায় সবাই এসেছেন। পড়শিরা সকলে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন কবে নাটক হবে।

আমাদের সঙ্গে এখন যাঁরা নাটক করেন, তাঁদের কেউ স্কুলে পড়ান, কেউ গৃহবধূ। নাটক জিনিসটা খুব ডেমোক্র্যাটিক। আইনজীবী, গুড় বিক্রেতা, পিওন সবাই এক সঙ্গে অভিনয় করতেন। যেমন, সহদেবকাকু অসামান্য মহিলার পার্ট করতে পারতেন। মানময়ী গার্লস হাই স্কুলে তাঁর সেই অতুলনীয় অভিনয় এখনও মনে দাগ কেটে রয়েছে। সুবোধকাকু, তুলসীদা, শিবপ্রসাদজেঠু, নরেশদা, ছানাদা প্রত্যেকে এত সক্ষম অভিনেতা ছিলেন! ওঁদের মতো করে অভিনয় করার চেষ্টা করে গিয়েছি আশৈশব। সমস্ত অনুপ্রেরণা ওঁদের কাছে পেয়েছি। মা যেমন হাতে ধরে স্বরে অ স্বরে আ লেখেন তার পর তাতে হাত বোলাতে হয়। আমার কাছেও ওঁরা তেমন ছিলেন।

কৃষ্ণ যাত্রা দেখতে যেতাম বন্ধুরা মিলে। ‘রাম রসায়ন’ দেখে এত অভিভূত ছিলাম, যে পরে তিজনবাইয়ের উপস্থাপনা আর তেমন নতুন বলে মনেই হয়নি। পতিরামে ভাদু মালাকার বলে এক যাত্রা অভিনেতা ছিলেন অসামান্য। এঁদেরকে সামনে থেকে দেখার সুযোগই আমাকে গড়ে তুলেছে। পরে রাজবংশী উপভাষায় ‘রক্তকরবী’ করার চেষ্টা করছি।

‘দেবীগর্জন’ করি ১৯৭৩ সালে। বিজনদারটা দেখেছিলাম। উনি অসম্ভব ভালবাসতেন আমাকে। শান্তিরঞ্জন গুহ, ধীরেন ঘোষ, সত্য তালুকদার— সকলে মিলে আমাদের ৫০ জনের প্রোডাকশন ছিল সেটা। আমি তখন বছর আঠাশ। তাঁরা পঞ্চাশ। আমাকে আক্ষরিক অর্থে জন্মাতে দেখেছেন যে সব গুরুজন পড়শিরা, তাঁদের যে কী অদ্ভুত সহযোগিতা পেয়েছি সে সময়ে! আমার সমস্ত কথা বাচ্চা ছেলেদের মতো শুনতেন। বলতেন, ‘‘এইখানটা এ ভাবে করব মাধব? দ্যাখ ত, ঠিক হইতাসে কি না?’’ কখনও ‘না’ বললে সঙ্গে সঙ্গে আমার চাহিদা মতো অভিনয় করে জানতে চাইতেন, ‘এই বার’? কোনও দিন আমার পরিচালনা নিয়ে তাঁরা কোনও প্রশ্ন করেননি। দেবাংশী তৈরির সময়ে মনসামঙ্গলের গান জোগাড় করে দেন অযোধ্যা গ্রামের এক চাষি।

এখনও বাজারে আড্ডা দিতে যাই। আলুওয়ালা, মাছওয়ালাদের সঙ্গেই আড্ডা জুড়ে দিই। বাজার না করা হোক, ওদের সঙ্গে আড্ডাটা আমার রোজকার রুটিন। দিনযাপনের জ্বালানি বলা যায়। যশোহরের ভাষায়, পুরুলিয়ার ভাষায় এদের মতো করেই টানা কথা বলে যাই। তাদেরকে যেমন বুঝি, যেমন দেখি, তেমনই নাটক করি। অভিজ্ঞতার বাইরে যাই না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE