Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ছাপ্পা আড়াল করতে যন্ত্র-চোখেও পট্টি

মানুষ নজরদারেরা যা বলেছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের নাকি আসমান-জমিন ফারাক! যে ‘উলটপুরাণের’ নেপথ্যে রাজনৈতিক চাপের ভূমিকা দেখছেন অনেকে। এবং অভিযোগ উঠেছে, যান্ত্রিক নজরদারদের রিপোর্ট এ ভাবে চাপ দিয়ে বদলানো যাবে না বুঝে বহু ক্ষেত্রেই তাদের চোখও ঢেকে রাখা হয়েছিল!

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:২৫
Share: Save:

মানুষ নজরদারেরা যা বলেছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের নাকি আসমান-জমিন ফারাক! যে ‘উলটপুরাণের’ নেপথ্যে রাজনৈতিক চাপের ভূমিকা দেখছেন অনেকে। এবং অভিযোগ উঠেছে, যান্ত্রিক নজরদারদের রিপোর্ট এ ভাবে চাপ দিয়ে বদলানো যাবে না বুঝে বহু ক্ষেত্রেই তাদের চোখও ঢেকে রাখা হয়েছিল!

প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরি হোক কিংবা মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসার (মহকুমাশাসক) বা তিন পর্যবেক্ষকের রিপোর্ট— শনিবার বিধাননগরের পুর নির্বাচনে ব্যাপক হিংসা-ছাপ্পাভোটের কোনও প্রতিফলন কার্যত কোথাওই নেই। বিরোধীদের দাবি: রাজ্য সরকারের অধীনস্থ ওই অফিসারেরা চাকরির দায়ে মুখ খুলতে সাহস পাননি। নির্বাচন কমিশনারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সেই সব ‘স্বাভাবিক’ রিপোর্টের ভিত্তিতেই। ফলে গোটা বিধাননগর পুরসভার ভোট খারিজ করে পুনর্নির্বাচন দেওয়া তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল, বলছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনেরই একাংশ। সোমবার তিনি কয়েকটি ওয়ার্ডে পুনর্নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। যদিও কোথায় ফের ভোটগ্রহণ হবে, তা স্পষ্ট করে বলেননি। ফলে তাঁর তালিকায় কোন কোন ওয়ার্ড ছিল, সেগুলিতে ফের ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্তের পিছনে কী কারণ ছিল, তা পরিষ্কার নয়।

কিন্তু ঘটনা হল, সরকারি অফিসারদের পাশাপাশি কয়েকটি ভোটকেন্দ্রকে নজরে রেখেছিল কিছু যান্ত্রিক চোখ, যাদের দিয়ে অবাস্তব রিপোর্ট তৈরি করানো সম্ভব নয়। সুতরাং সেগুলো যাতে আসল
সময়ে খোলা না-থাকে, তার পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছিল বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।

যান্ত্রিক চোখ, অর্থাৎ ওয়েবক্যাম ও হ্যান্ডিক্যাম। কমিশন-সূত্রের খবর: বিধাননগর পুরসভার ৪১টি ওয়ার্ডের ৪৩৮টি বুথের একশোটিতে ওয়েবক্যাম বসানো হয়েছিল। ৬৫টিতে ছিল হ্যান্ডিক্যাম, যেগুলো ভাড়া করা হয়েছিল এক বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে। ক্যামেরা চালানোর দায়িত্বে ছিলেন সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মীরা। কমিশনের এক অফিসার জানাচ্ছেন, ওয়েবক্যাম ঘেঁটে ও হ্যান্ডিক্যাম-অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাঁদের হাতে এসেছে। কী রকম? তথ্য বলছে:

১) শনিবার সকাল এগারোটার পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বুথে ঢুকে বহিরাগতেরা ওয়েব-ক্যামেরার চোখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। তাই পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কোনও ছবি তাতে ধরা পড়েনি। ‘অপারেশন’ শেষ করে ঢাকনা খুলে দেওয়া হয়।

২) কয়েকটি বুথে ওয়েবক্যামেরার চোখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে তখন কোনও ছবি ওঠেনি।

৩) হ্যান্ডিক্যাম রাখা বুথে ‘অভিযানের’ আগে ক্যামেরাম্যানদের বুথ থেকে বার করে দেওয়া হয়। কেউ কোনও ‘অস্বস্তিকর’ ছবি তুলে থাকলে তা জবরদস্তি মুছিয়ে (ডিলিট) ফেলতেও কসুর করা হয়নি।

এমতাবস্থায় ভোটগ্রহণের স্বচ্ছতা সম্পর্কে কমিশনের অন্দরে সন্দেহ দৃঢ়তর হচ্ছে। এক কর্তার পর্যবেক্ষণ, একশো বুথে ওয়েবক্যামের তথ্যই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ওখানে কখনও না কখনও গোলমাল হয়েছিল। সে কারণেই ক্যামেরা ‘ট্যাম্পার’ করার দরকার পড়েছে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘গোলমেলে কাজকর্ম কতটা সময় ধরে হয়েছে, তার তথ্যও যন্ত্রে রয়েছে। কোর্টে মামলা হলে সে সব অস্বীকার করা যাবে না। বড় জোর বলা যেতে পারে, ওই সময়ে ক্যামেরাগুলো যান্ত্রিক কারণে বিগড়ে গিয়েছিল।’’

তবে সে যুক্তিও ধোপে টিকবে কি না, সে ব্যাপারে কমিশন-কর্তাদের অনেকে ঘোরতর সন্দিহান। ওঁদের বক্তব্য, জল আদালতে গড়ালে প্রশাসন তথা কমিশনের দায় এড়ানো দস্তুরমতো কঠিন হবে। কেন?

কমিশন-সূত্রের ব্যাখ্যা: সল্টলেকের পুরভোটে গোলমালের আশঙ্কা সব মহলেই ছিল। এমনকী, গোয়েন্দা-রিপোর্টেও আগাম হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। এ হেন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠতে পারে, ৪৩৮টি বুথের মধ্যে মাত্র ১৬৫টিতে কেন ক্যামেরা রাখা হল? কমিশনের প্রাক্তন এক কর্তার কথায়, ‘‘বিধানসভা বা লোকসভায় বহু জায়গায় একসঙ্গে ভোট করাতে হয় বলে সর্বত্র ক্যামেরা রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু এখানে তো আর মাত্র পৌনে তিনশো ক্যামেরা বসালেই পুরোটা যান্ত্রিক নজরদারির আওতায় চলে আসত!’’

সেটা কেন করা হল না, অনেক আধিকারিকের তা মাথায় ঢুকছে না। এ দিকে বিধাননগরের পাশাপাশি আসানসোলেও পুর নির্বাচনের ভোটগ্রহণের সময়ে ক্যামেরা বন্ধ রাখার অভিযোগ উঠেছে। ওখানকার ৯৬৭টি বুথের ৪৯৭টিতে ভিডিওগ্রাফির ব্যবস্থা ছিল। ‘কারচুপি’ ফাঁস করার জন্য বিরোধীরা ভিডিও চেয়ে আবেদন করেছে। রিটার্নিং অফিসার তথা মহকুমাশাসক (আসানসোল) অমিতাভ দাস মঙ্গলবার জানান, ভিডিওগুলো তাঁদের কাছে জমা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন যখন চেয়ে পাঠাবে, পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ‘‘কমিশন নির্দেশ দিলে বিরোধীদের হাতেও তুলে দেওয়া হবে।’’— বলেন মহকুমাশাসক।

বস্তুত গোটা পরিস্থিতি দেখে কমিশনের আগাম সক্রিয়তার ঘাটতি সম্পর্কে আক্ষেপ জোরদার হচ্ছে। প্রাক্তন ও বর্তমান অফিসারদের কেউ কেউ বলছেন, কমিশন নিজের অফিসে বসে ওয়েবক্যাম মারফত সব বুথের ছবি সবাসরি দেখে ভোট নিয়ন্ত্রণের বন্দোবস্তও করতে পারত, যেমনটি জাতীয় নির্বাচন কমিশন করে থাকে। তা হলে কী হয়েছে-না হয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকত না।

যদিও এখন যে আর আক্ষেপ করে লাভ নেই, ওঁরা সেটাও জানেন। ‘‘কী থেকে কী হয়েছে, তা তো জলের মতো স্পষ্ট!’’— কটাক্ষ করেছেন এক আধিকারিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE