Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ছেলেটাকে চিনি, নিজের ছবি দেখিয়ে বলল দুর্জয়

সাতসকালে আনন্দবাজার খুলেই চমকে উঠেছিল লিকপিকে ছেলেটা। ঝাপসা ঝাপসা, কিন্তু এ তো তার নিজেরই ছবি। তবে বেশ কয়েক বছর আগের। ছবির সঙ্গে যে খবর, তাতে লেখা রয়েছে, তার মামা বাংলাদেশ থেকে এ দেশে চলে এসেছেন।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও দীক্ষা ভুঁইয়া
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৫ ০২:৫৫
Share: Save:

সাতসকালে আনন্দবাজার খুলেই চমকে উঠেছিল লিকপিকে ছেলেটা। ঝাপসা ঝাপসা, কিন্তু এ তো তার নিজেরই ছবি। তবে বেশ কয়েক বছর আগের। ছবির সঙ্গে যে খবর, তাতে লেখা রয়েছে, তার মামা বাংলাদেশ থেকে এ দেশে চলে এসেছেন। চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ভাগ্নে দুর্জয় ভক্তির খোঁজে ঘুরছেন দোরে দোরে। কিন্তু কিছুতেই কোনও সন্ধান পাচ্ছেন না।

সেই দুর্জয়ের হালফিলের ঠিকানা কামালগাজির এক অনাথ আশ্রম। চেহারায় পরিবর্তন আসায় খবরের কাগজের ছবি দেখে অবশ্য আশ্রমের কর্তারা বুঝতে পারেননি, এটা দুর্জয়ের ছবি। আরও বুঝতে পারেননি, কারণ অনাথ আশ্রমের খাতায় তার নাম তো ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী! আশ্রমের কর্তাদের এ দিন দুর্জয় বলে, ‘‘দুর্জয় ভক্তি নামে ওই ছেলেটাকে আমি চিনি। যে করেই হোক ছেলেটাকে বাড়ি ফেরাতেই হবে।’’ তার পর স্কুল সেরে বিকেলে স্কুলের পোশাকেই শিয়ালদহে স্টেশনে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে হাজির হয় সে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিচিত কর্মীকে দেখতে পেয়ে দুর্জয় জানায়, তাকে আনন্দবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে। তা হলেই সে ফিরে যেতে পারবে নিজের বাড়িতে।

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আনন্দবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যশোর থেকে যখন দুর্জয়কে খুঁজতে এসেছিলেন তার মামা সুব্রত মণ্ডল, তখন আনন্দবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল তাঁর। মঙ্গলবার দেশে ফেরার আগে তিনি তাঁর ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন। বুধবার ওই নম্বরে ফোন করা হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে বসেই যশোরে মামার সঙ্গে কথা হল দুর্জয়ের। দীর্ঘ চার বছর বাদে এই প্রথম বাড়ির কারও সঙ্গে কথা। ‘মামা কবে আসবে আমায় নিতে’— বলতে বলতেই গলা বুজে আসে দুর্জয়ের। ফোন রেখে হাপুস কাঁদতে থাকে বছর পনেরোর সপ্রতিভ কিশোর।

কে এই দুর্জয়? কী ভাবেই বা তার ঠাঁই হলো এ পারের এক অনাথ আশ্রমে?

বুধবার বিকেলে দুর্জয়ের নিজের মুখ থেকেই শোনা গেল সেই গল্প।

২০১১ সালের ইদের আগের দিন সীমান্তের কাছে পাটবা়ড়িতে উৎসবে যোগ দিতে এসেছিল দুর্জয়। সেখানে লুকোচুরি খেলতে খেলতে সীমান্তের একদম কাছে এসে পড়ে। হঠাৎই সে দেখে লোকজন ছুটোছুটি করছে। সে-ও ছুট লাগায়। দুর্জয় বলে, ‘‘একটা লোক আমাকে নিয়ে ছুটতে থাকে। অনেক ক্ষণ ছোটার পরে সে আমায় বলে, তুই ভারতে ঢুকে গিয়েছিস। আর ফিরতে পারবি না।’’ এর পরে সেই লোকটার সঙ্গেই কলকাতায় চলে আসে দুর্জয়। ওই লোকটার সঙ্গেই থাকত সে। তাকে মাদক পাচারের কাজে লাগাত লোকটা। তার সঙ্গেই ট্রেনে চেপে নানা জায়গায় ঘুরেছে দুর্জয়।

মাদকপাচারের মতো অন্যায় কাজ করতে ভাল লাগত না দুর্জয়ের। তাই ফের এক দিন ছুট দেয় সে। শিয়ালদহে এসে পুলিশের কাছে যায়। এ দেশে আসার পরেই ওই মাদকপাচারকারী তাকে শিখিয়েছিল, ধরা পড়লে ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী বলে নিজের পরিচয় দিতে। ভুলেও যেন বাংলাদেশে বাড়ি বা বাবা-মায়ের কথা না বলে। তা হলে জেলে পুরবে পুলিশ। সেই মতো দুর্জয় নিজের নাম ‘ইন্দ্রনারায়ণ’ বলতেই তার ঠাঁই হয় হাওড়ার মালিপুকুর হোমে। সেই হোমের বিরুদ্ধে এ দিন একগুচ্ছ অভিযোগ জানিয়েছে কিশোরটি। বলল, ‘‘ওখানে পচা খাবার দিত, পোকাও থাকত। নোংরা জামাকাপড় দিত। কিছু বললে মার জুটত। মারতে মারতে হাত-পা কেটে গেলে সেখানে নুন দিয়ে দিত।’’

মার খেতে খেতে সে এক সময় ভাবে, আসল নাম বললে হয়তো বাংলাদেশে ফেরা যাবে। সেই মতো মালিপুকুর হোমের কর্তৃপক্ষকে নিজের আসল নাম বলেছিল সে। তার কথায়, ‘‘আমি বাংলাদেশি শুনতেই আরও মারধর করতে থাকে ওরা।’’ তার পরেই সেখান থেকে পালায় সে। তত দিনে অবশ্য হোম থেকে সমাজকল্যাণ দফতর মারফত দুর্জয়ের কথা চলে গিয়েছে বিদেশ মন্ত্রকের কাছে। সমাজকল্যাণ দফতর বলছে, দুর্জয় পালানোর খবর হোম তাদের জানায়নি। দুর্জয় কোনও দিন তাদের কাছে ছিল বলেও অস্বীকার করে। এ নিয়ে ওই হোমের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে।

মালিপুকুর থেকে পালিয়ে ফের শিয়ালদহ স্টেশনে আসে দুর্জয়। এ বার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। এ বার আর ‘দুর্জয়’ নাম বলেনি সে। তবে হাওড়ার ওই হোমে কী রকম অত্যাচার হতো, সে কথা জানিয়েছিল। তার পরেই তাকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কামালগাজিতে ‘ইচ্ছে’ নামে অনাথ আশ্রমে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে একটি স্কুলে ভর্তি হয় দুর্জয়। এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে সে। এ দিন ওই স্কুলের পোশাকেই শিয়ালদহে হাজির হয়েছিল সে। হাতে ধরা ছিল আনন্দবাজার।

এ দিন রাতে যশোর থেকে তার মামা সুব্রত মণ্ডল ফোনে বলছিলেন, ‘‘ওর মা আনন্দে খালি কাঁদছেন। ওঁকে সঙ্গে নিয়ে কাল, বৃহস্পতিবারই আমরা ইন্ডিয়া যাচ্ছি!’’ রাজ্যের সমাজকল্যাণ দফতরের অফিসারেরা বলছেন, বিদেশি হওয়ায় দুর্জয়ের বাড়ি ফেরায় কিছুটা হলেও আইনি জট রয়েছে। তবে দফতরের মন্ত্রী থেকে সচিব— সবাই আশ্বাস দিয়েছেন, দুর্জয়কে বাড়ি ফেরানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাতে ফের কামালগাজির আশ্রমে ফিরে যায় দুর্জয়। চোখে স্বপ্ন, চার বছর পরে এ বার মায়ের সঙ্গে দেখা হবে তার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE