Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
অামার পড়শি

জঙ্গলমহালে উঁকি ‘হাতি’ ও ‘বনপাটি’র

সুবর্ণরেখা নদীপাড়। খেড়িবিলের ধার। পড়শি বড়ডাঙা গ্রামের ‘হাটুয়া’ মেয়ে ভারতী বধুক, মন্দাকিনী বিশুই, মিনতি দঁড়পাটরা ছেড়ি-ছাগল ছেড়ে বই খুলে ইংরেজি পড়া পড়ছে—‘‘দেয়ার ইজ এ ফ্রগো, সেঠিরে গুটো ব্যাঙো....।’’

নলিনী বেরা
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:১১
Share: Save:

সুবর্ণরেখা নদীপাড়। খেড়িবিলের ধার। পড়শি বড়ডাঙা গ্রামের ‘হাটুয়া’ মেয়ে ভারতী বধুক, মন্দাকিনী বিশুই, মিনতি দঁড়পাটরা ছেড়ি-ছাগল ছেড়ে বই খুলে ইংরেজি পড়া পড়ছে—‘‘দেয়ার ইজ এ ফ্রগো, সেঠিরে গুটো ব্যাঙো....।’’

ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার বারিপদা মহকুমার মুরুতা থেকে জামাইবাবু প্রফুল্ল বেহেরা কুটুম্বিতা করতে গ্রামে এসেছেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘নলিনী, ঝাড়া যিব-অ?’’ অর্থাৎ ‘বড় বাইরে’ সারতে তার সঙ্গে যাব কি না!

—এ ভাবেই প্রকৃতির মেঘ, রোদ, ছায়ার মতো আমাদের মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ওড়িয়া ভাষা। ঠিক ওড়িয়া তো নয়, একে বলে ‘হাটুয়া ভাষা’। রাজু তেলি, সদগোপ করণ, কৈবর্ত খণ্ডায়েৎদের ভাষা।

কেন না ১৮০৩ সাল পর্যন্তও আমরা তো ছিলাম সাবেক উৎকলের মধ্যে। এই সেদিন ১৯৩১-এ বিহার থেকে ছেঁটে যখন ওড়িশা পৃথক রাজ্য হচ্ছে, তখন ওড়িশাবাসীরা দাবি করে বসল নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, সাঁকরাইল, কেশিয়াড়ি, ঝাড়গ্রাম, দাঁতন, মোহনপুর, কাঁথি, এগরা, রামনগর, পটাশপুরকেও তাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হোক।

স্যর ওডোনেলের সভাপতিত্বে কমিটি বসল। দড়ি টানাটানিও চলল ঢের। ছিঁড়ে যায়-যায় আর কী! দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল আন্দোলন করে সে প্রস্তাব রুখলেন। ১৯৩২-এর ১৮ এপ্রিল ওডোনেল কমিটির রিপোর্টে আমরা বঙ্গবাসী হলাম।

তবে না-ঘরকা না-ঘাটকার মতো। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা নদী যেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় আলাদা করে দিয়েছে। বর্ষায় যখন নদী-নালা একাকার হয়ে যায়, ‘নদী সেপারের’ পড়শি গ্রাম আঁন্ধারি, রোহিণী, লবকিশোরপুরের ঘাট আর ‘নদী এপারের’ বড়ডাঙা, নুয়াসাই, রামচন্দ্রপুর, থুরিয়ার ঘাট এক হয়ে যায়। নদী পাড়ের গ্রাম খান্দারপাড়া, দেউলবাড়, পাতিনা, মলতাবনী আধাআধি জলের তলায়। নদীর মাছ, কাছিম, বালিগড় অনায়াসে গবাদি পশুর পায়ে পায়ে ছরছরিয়ে উঠে আসে আমাদের ইস্কুল ডাঙায়। এ অবস্থায় আমাদের গ্রাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেন পৃথিবীর একেবারে বাইরে এসে পড়ে।

রীতিমতো ‘আউটসাইডার’। এক দিকে নদী, আরেক দিকে ওড়িশা লাগোয়া ঘনঘোর ঘোড়াটাপুর আর তপোবন ‘জঙ্গলমহাল’। মাঝখানে আমার জন্মভূমি গ্রাম তথা পাড়া বাছুরখোঁয়াড়। জেএল নম্বর ৩৮। থানা নয়াগ্রাম।

থেকে থেকে আওয়াজ ওঠে— ‘ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্!’ বাছুর খোঁয়াড়ের আঁথোল, কুমহাররা ‘আঁথোলে’ কাঁচা ‘ভৈঁইচা’ রেখে মাঝে মাঝে তার গায়ে ভিজে ন্যাকড়া অর্থাৎ ন্যাতা বুলিয়ে সন্তানের মতো আদর করে। তার পরই আচমকা ‘পিঁড়োল’ ‘পিটনা’ দিয়ে পিটতে শুরু করে। তারই আওয়াজ-ঢুব্ ঢুব্! ঢুবঢুবানি যেন কুম্ভকার পদাবলী।

বেলপাহাড়ির লালজলে তোলা নিজস্ব চিত্র।

এই গ্রামের এ-প্রান্তে আওয়াজ উঠল তো, ওই আওয়াজ উঠল সে-প্রান্তেও। এ প্রান্ত, সে প্রান্ত আওয়াজ তুললে মাঝবরাবর যে আছে সেও কেন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? সেও শুরু করে দিল তুমুল বিক্রমে। সম্মিলিত আওয়াজে তখন কানপাতা দায়! ‘ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্ ঢুব্....!’

এখানে রাতে পথচলতি কোনও ভিন গাঁয়ের পথিক কিংবা অদূরবর্তী প্রতিবেশী ‘হাটুয়া’ গ্রাম বড়ডাঙা, চঁদরপুর, খান্দারপাড়া, দেউলবাড়ের ‘হাটুয়া’রা তাই শুনে পরিহাসছলে বলে, ‘‘কুঁভারের পেট আর কুঁভিরের পেট— কুনো তফাত নাই’’।

তদুপরি গ্রামেরই শ্রীসুদর্শন বেরা এত সব সাতকাহন কথা নিয়ে লিখে ফেলেছে একটা ‘কুম্ভপুরাণ’, নাম— ‘‘সৌতি শ্রীসুদর্শন। পিতা শ্রীদাম। মেদিনীপুর জিলার বাছুরখোঁয়াড় গ্রাম।। জাতি কুম্ভকার মুই গোত্র নাগেশ্বর। প্রথমে বন্দনা করি আদি মহেশ্বর....।’’

বাছুরখোঁয়াড় কুম্ভকার পল্লির উপর আর নীচ, দু’দিকেই সাঁওতাল পাড়া। পুরা, খালকা, টপা, কুলাই, কাঁদরা, সামাই, ভটা আর ধনু সাঁওতালদের ঘর। তার মধ্যে আবার দু’ঘর কামহারও আছে। মোহন আর রামচন্দ্র রানা।

‘‘আমাদের ছোট গাঁয় ছোট ছোট ঘর, একসাথে থাকি মোরা নাহি কেহ পর।’’ প্রকৃত প্রস্তাবে বাছুরখোঁয়াড় কুম্ভকার গ্রামখানাও তাই। তাই...তাই সামাই সাঁওতালের ঘরের চালের উপর ওঠা লাউয়ের লতি, ডিংলার ডগাল নিজেদের চৌহদ্দি ছাড়িয়েও এসে পড়ে আশুতোষ কুমহারের ঘরের চালের উপর।

আমাদের দখিনসোলের মাথায়। গোঠ-টাঁড়ের মাঠের ধারে। এই ক’বছরে দিঙ্ দিঙ্ করে এসে পড়েছে পিচ রাস্তা। তার মানে কি সভ্যতা...?

সাঁঝ হলেই রদোবদো করে ঝিঙাফুল ফোটে। বহেড়া, শাল, পিয়াশাল, ধ, আসনের উঁচালে ফুটি ফুটি করে তারা ওঠে। ‘‘একটি তারা দুটি তারা কোন তারাটা আরাঝারা?’’ বস্তুত সব তারাই আরাঝারা হয়ে গেলে কাঁধে, মাথায় কাঠ নিয়ে টঙস্ টঙস্ করে বেরিয়ে পড়ে সুখজুড়ি, মোরখুলি লোধাবস্তির পড়শিরা। আর গুরভা, গুড়গুড়িয়া, পিঁছাড়ি, সোমবারি, শনিচরীরা। পশ্চাতে......

মাঝেমধ্যেই জঙ্গলের ডালপালার ফাঁকফোঁকর দিয়ে উঁকি মারে পড়শি ‘হাতি’ ও ‘বনপাটি’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE