Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ঘুঘড়াগাছির বাইশ বিঘা

জমির মালিকানা নিয়ে ধন্দ

জমির দখল নিয়েই যত গোলমাল। প্রাণ গিয়েছে নিরীহ বধূর। জখম আরও কয়েক জন। নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছিতে ওই বাইশ বিঘা জমি যে আসলে কার নামে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটল না এখনও। সরকারি নথি বলছে, ওই জমিটি নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার ১০ নম্বর ঘুঘড়াগাছি মৌজায়। নদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি রাজস্ব) অভিজিৎ ভট্টাচার্য জানান, ওখানে মোট ৮.২৮ একর পরিমাণ জমি আছে। ১৮২৪, ১৮২৫, ১৮২৬ এই তিনটি দাগ নম্বরের প্রতিটিতে ২.৭৬ একর পরিমাণ জমি আছে।

কৃষ্ণগঞ্জ থানায় আটক সেই ট্রাক্টর

কৃষ্ণগঞ্জ থানায় আটক সেই ট্রাক্টর

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৯
Share: Save:

জমির দখল নিয়েই যত গোলমাল। প্রাণ গিয়েছে নিরীহ বধূর। জখম আরও কয়েক জন। নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছিতে ওই বাইশ বিঘা জমি যে আসলে কার নামে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটল না এখনও।

সরকারি নথি বলছে, ওই জমিটি নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার ১০ নম্বর ঘুঘড়াগাছি মৌজায়। নদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি রাজস্ব) অভিজিৎ ভট্টাচার্য জানান, ওখানে মোট ৮.২৮ একর পরিমাণ জমি আছে। ১৮২৪, ১৮২৫, ১৮২৬ এই তিনটি দাগ নম্বরের প্রতিটিতে ২.৭৬ একর পরিমাণ জমি আছে। এই জমিটি রাজ্যের উদ্বাস্তু ত্রাণ এবং পুনর্বাসন দফতরের অধীন। সরকারি রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে ওই দফতরের পক্ষ থেকে ১৯৮২ সালে ফটিকচন্দ্র সরকারকে ৭.১৫ একর জমি এবং ১৯৮৫ সালে শশধর জোয়ারদারকে ১.৬৫ একর জমি ‘ফ্রি হোল্ড টাইটেল ডিড’ বা বিশেষ পাট্টা দেওয়া হয়। এই পাট্টার বৈশিষ্ট্য হল দশ বছর জমির মালিকানা হস্তান্তরযোগ্য। জানা গিয়েছে পরবর্তী সময়ে শশধর জোয়ারদারের ওই ১.৬৫ একর জমির ১.৩২ একর পুতুল চৌধুরী (স্বামী বিশ্বনাথ চৌধুরী) এবং ০.৩৩ একর লক্ষ্মী চৌধুরীর (স্বামী অনিল চৌধুরী) নামে হস্তান্তরিত এবং নথিভুক্ত হয়। তবে ফটিকচন্দ্র সরকারের ৭.১৫ একর জমি এখনও কারও নামে হয়নি। অন্তত ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের রেকর্ডে এমন কিছু উল্লেখ নেই।

মজার বিষয় হল, শশধর চৌধুরী বা ফটিক সরকারের কোনও হদিশ নেই ওই এলাকায়। ফটিকবাবু সম্পর্কে তবু শোনা যাচ্ছে, তিনি নাকি কলকাতায় থাকেন। কিন্তু শশধরবাবু কে-কোথায় থাকেন, হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারছেন না এলাকার বাসিন্দারা। ১৯৮৫ সাল নাগাদ ‘মালিকানাহীন’ ওই ভূমিখণ্ড ৫৬টি পরিবারের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল বলে এলাকাবাসীর দাবি। বাম জমানায় ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ করে যে বিলি-বণ্টন হয়, তার উল্লেখ নেই প্রশাসনের কাছে। ব্যক্তিগত জমি আইনত পাট্টা দেওয়া সম্ভব নয় জেনে বামেরাও আর ঘাঁটায়নি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রত্যেকের ভাগে কমবেশি আট কাঠা করে জমি মিলেছিল। তাতে চাষআবাদ করেই দিন গুজরান করতেন অপর্ণা বাগ, লতিকা তরফদাররা। ৩০ বছর ধরে নিত্য দিনের সংসারে চরম অভাব থাকলেও উৎখাত হওয়ার ভয় ছিল না। আধপেটা খেয়ে দিন কাটানোর অভ্যাস থাকলেও খুনের হুমকি শুনে রাতে শুতে যাওয়ার অভ্যাস ছিল না।

বছর দু’য়েক আগে সমাজবিরোধী বলে কুখ্যাত লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কার নজর জমির উপরে পড়ার পর থেকেই শনির দশা শুরু হয়। প্রায় তিরিশ বছর ধরে চাষবাস করলেও ওই পরিবারগুলি কেউই এখনও জমির পাট্টা পাননি—এই তথ্যকে হাতিয়ার করে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নামেন লঙ্কা। সিপিএম সমর্থক পরিবারগুলিকে উৎখাত করার ওই কাজে এলাকার দাপুটে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা লক্ষ্মণ ঘোষ চৌধুরীর বিলক্ষণ মদত ছিল বলে দাবি এলাকার বাসিন্দাদেরর।

প্রসঙ্গত, কৃষ্ণগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে বাম আধিপত্যের ক্ষয় ধরেছিল অনেক দিন আগেই। পরপর দু’বার ওই পঞ্চায়েত সমিতি গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। গত পঞ্চায়েত ভোটে পঞ্চায়েত সমিতির সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েতে মধ্যে মাত্র দু’টি বাদে সবক’টি তৃণমূলের দখলে চলে যায়। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং বিধানসভা সর্বত্র একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে জমি থেকে আইনশৃঙ্খলা সব বিষয়েই শেষ কথা বলেন তৃণমূলের কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক সভাপতি লক্ষণ ঘোষচৌধুরীর মতো নেতারা। পাশাপাশি এদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে গত কয়েক বছর ধরে এলাকায় এক ছটাক জমিও লঙ্কা ঘোষদের বাদ দিয়ে কেনাবেচা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। আর কাগজপত্রে কোথাও গোলমাল থাকলে তো কথাই নেই। যে কোনও মূল্যে সেই জমি লঙ্কা ঘোষ দখল করবেই। যেমন ভাবে রবিবার ঘুঘড়াগাছিতে লঙ্কার নেতৃত্বে গরু পাচারকারীদের দল হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

মারধর, হুমকির মতো অস্ত্রগুলো তো রয়েছেই জমি মাফিয়াদের। হঠাৎ বোমা-গুলি নিয়ে হামলা কেন?

রাজনৈতিক মহলের মতে, গত কয়েক মাস ধরে গোটা রাজ্যের সঙ্গে কৃষ্ণগঞ্জের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে দিয়েছে। লোকসভা ভোটে জেলার প্রায় সর্বত্র বিজেপি-র প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি সারদা এবং খাগড়াগড় কাণ্ডের জেরে তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা বেকায়দায়। বিরোধীহীন কৃষ্ণগঞ্জে আবার একটু একটু করে সংগঠিত হচ্ছে সিপিএম। অন্য দিকে মাথা চাড়া দিচ্ছে বিজেপিও। এই প্রেক্ষিতে ওই গ্রামে হামলা করার নামে সন্ত্রাস ছড়ানোটাই তৃণমূলের লক্ষ্য ছিল দাবি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির। সে কাজে লঙ্কা আর তার দলবলকে ‘ব্যবহার’ করা হয়েছিল বলে মনে করছে তারা।

লড়াইটা জমির না রাজনীতির— সেই ধন্দটা রয়েই গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE