Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জল ছাড়াতেই কি বন্যা, তরজায় মমতা-ডিভিসি

বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন বরাবর বাংলার বন্যাকে ‘ম্যানমেড’ বলে আখ্যা দিতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় আসার পরে চার বছর ‘ম্যানমেড’ বন্যা হতে দেননি বলেও ক’দিন আগে দাবি করেছেন তিনি। কিন্তু এ বারে ভারী বর্ষণ এবং ভরা কোটাল একসঙ্গে মিলে বিপদ বাড়িয়েছে, স্বীকার করেছিলেন তিনি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন বরাবর বাংলার বন্যাকে ‘ম্যানমেড’ বলে আখ্যা দিতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় আসার পরে চার বছর ‘ম্যানমেড’ বন্যা হতে দেননি বলেও ক’দিন আগে দাবি করেছেন তিনি। কিন্তু এ বারে ভারী বর্ষণ এবং ভরা কোটাল একসঙ্গে মিলে বিপদ বাড়িয়েছে, স্বীকার করেছিলেন তিনি। মঙ্গলবার কিন্তু পুরনো সুরেই ফের দোষ চাপালেন ডিভিসি-র উপরে। পাল্টা জবাব দিতে মাঠে নামল ডিভিসি-ও।

রবিবার নবান্নয় রাত কাটিয়ে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কোথায় কোন বাঁধ থেকে কতটা জল ছাড়া হচ্ছে, নিজে তার দিকে নজর রেখেছিলেন তিনি। পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘আমাদের সরকার বিভিন্ন জলাধার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ফলে জল ছাড়লেও আমার প্রস্তুত রয়েছি।’’ এ দিন নবান্নে রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন মমতা। ওই বৈঠকের পরে কিন্তু তিনি অভিযোগ করলেন, ডিভিসি অতিরিক্ত জল ছেড়ে রাজ্যকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘ডিভিসি ব্যবসা করবে বাংলায়, তাদের হেডকোয়ার্টার বাংলায়, আর ডুবিয়ে দেবে আমাদের— এটা হতে পারে না।’’ এই বক্তব্য শুনে বিরোধীরা বলছেন, মমতা যথারীতি তাঁর পুরনো তত্ত্বেই ফিরে গেলেন! বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘ডিভিসির ঘাড়ে দোষ চাপানো মানে তো সেই ম্যানমেড বন্যার কথাই বলা!’’

চুপ করে থাকেনি অবশ্য ডিভিসি-ও। সংস্থার চেয়ারম্যান এ ডব্লিউ কে ল্যাংস্টি এ দিন মাইথন ঘুরে যান। তার পরেই ডিভিসি-র তরফে বিবৃতি দিয়ে দাবি করা হয়, তাদের ছাড়া জলের জন্য নয়, ভরা কোটাল এবং ঘূর্ণিঝড় গোমেনের প্রভাবই পশ্চিমবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির কারণ। ডিভিসি-র বক্তব্য, তাদের জলাধারগুলি ১ লক্ষ ১০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত জল নির্বিঘ্নে ছাড়তে পারে। কিন্তু সোমবার সর্বোচ্চ ৯৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে ডিভিসি-র জলাধার থেকে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডে গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ সত্ত্বেও পাঞ্চেত এবং মাইথনে তারা ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত জল নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। রাজ্যের বন্যা নিয়ন্ত্রণে সংস্থার ভূমিকায় চেয়ারম্যান ল্যাংস্টি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলেও দাবি করেছে ডিভিসি।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন

মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, যে ভাবে ডিভিসি পশ্চিমবঙ্গকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, তিনি তার শেষ দেখে ছাড়বেন। এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনেও মমতা বলেন, ‘‘আমি দু’টি কাজ নিয়ে ১১ এবং ১২ অগস্ট দিল্লি যাচ্ছি। ১১ অগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়েছি। তাঁর কাছে ডিভিসি-র বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাব। কেন্দ্রীয় বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল থেকে টাকা চাইব।’’

ডিভিসি-র ভূমিকায় তিনি যে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ, তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘আজ সকালে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে আমি ফোন করেছিলাম। তাঁকে বলেছি, দয়া করে আর জল ছাড়বেন না। আপনার বেবি (শিশু) আপনি সামলে রাখুন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনও তিনি ডিভিসি-র আধুনিকীকরণের দাবি জানিয়ে তাঁকে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের উত্তরে এ দিন ডিভিসি-র এক অফিসার পাল্টা বলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মনে রাখা উচিত ডিভিসি-র প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ

শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের নয়। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার, ঝাড়খণ্ড সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমান অংশগ্রহণ রয়েছে। জলাধারগুলি থেকে কত জল ছাড়া হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি। সেই কমিটিতে কেন্দ্রীয় জল কমিশনের সদস্য সচিব এবং ডিভিসি-র চিফ

ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) ছাড়া ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের সেচ দফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ারেরাও থাকেন। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না বলেই ডিভিসি-র দাবি। এর জবাবে রাজ্য সেচ দফতরের এক কর্তা আবার অভিযোগ করছেন, ওই কমিটিতে রাজ্যের কথা শোনা হয় না। কেন্দ্রের মতামতই গুরুত্ব পায়।

মমতার অভিযোগ, ডিভিসি-র জলাধারগুলির ড্রেজিং করা দরকার। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীকেও তিনি এ কথা জানিয়েছেন। মমতার মতে, ডিভিসি-র জলাধারে ড্রেজি়ং করে জলধারণের ক্ষমতা অনেকটা বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না।

এই ব্যাপারে ডিভিসি-র ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশের ব্যাখ্যা, জলাধারের অতিরিক্ত জল চালান করার কথা যে সব খাল এবং নদীতে, সেগুলির জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়াতেই বন্যা হচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে ডিভিসি-র আধিকারিকদের একাংশ বলছেন, গত কয়েক দশক ধরে দুর্গাপুর ব্যারাজে বালি-পলি জমে নাব্যতা কমে গিয়েছে। ফলে মাইথন ও পাঞ্চেত থেকে জল ছাড়লেই আশপাশের অঞ্চল ভেসে যাচ্ছে। ডিভিসি-র এক ইঞ্জিনিয়ারের আরও মন্তব্য, ‘‘খাল সংস্কার না হওয়ায় এ বার অতিবৃষ্টিতে ডুবেছে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকা।
এ সবও কি ডিভিসি-র জল ছাড়ার জন্য হয়েছে?’’ কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশও মনে করছেন, ড্রেজিং নিয়ে ডিভিসি-র একার ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ দফতরের অধীনে যে নদী-নালাগুলি রয়েছে, দীর্ঘদিন সেখানকার পলি তোলার কাজ হয়নি। বহু জায়গায় নদীর জমি দখল করে জনবসতি গড়ে উঠেছে। তার দায় কে নেবে?

এর উত্তরে আবার সেচ দফতর দাবি করছে, ডিভিসি-র জল খালবিলে এসে পড়ে না। নদী সংস্কারের সামর্থ্য রাজ্যের একার নেই। এ দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি সংক্রান্ত যে চিঠি লিখেছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী, তাতেও বাঁধের জল ছাড়ার প্রসঙ্গ রয়েছে। ত্রিপাঠী চিঠিতে বলেছেন, ‘‘প্রবল বৃষ্টি এবং কয়েকটি নদীবাঁধ থেকে জল ছাড়ার কারণে এ রাজ্যের ১২টি জেলার ২২২ ব্লক প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত।’’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর অনুরোধ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকগুলিকে আর্থিক সাহায্য করার নির্দেশ দিন। এ দিন নবান্ন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীরও নির্দেশ, ১৮ অগস্টের মধ্যে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE