তাঁকে এবং উপাচার্যকে খুন করার হুমকি দিয়ে নাকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টার পড়েছে। সেই পোস্টারের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে তৃণমূলের তরুণ সাংসদ তথা মুখ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার লিখেছেন, “তা হলে এটাই আসল উদ্দেশ্য! আমাকে স্থান ও সময় জানিয়ে দিলে আমি না হয় সেখানে হাজির হয়ে যাব। কিন্তু ক্যাম্পাসে শান্তি থাকুক।” নিজস্ব চিত্র
এক দিকে সরকারের গড়া কমিটির কাজ শুরু। অন্য দিকে পুলিশের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ। দুইয়ে মিলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিগ্রহের তদন্ত এ বার কিছুটা গতি পেল।
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ২৮ অগস্টের ওই ঘটনার তদন্তের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে মাথায় রেখে রাজ্য শিক্ষা দফতর পাঁচ সদস্যের যে কমিটি গড়েছে, মঙ্গলবার তা কাজে নেমেছে। কমিটির কিছু সদস্য এ দিন নিগৃহীতা ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। কমিটি-সূত্রের খবর: তদন্তকারীদের কাছে বক্তব্য জানিয়েছেন ছাত্রীটি। এ-ও বলেছেন, অভিযুক্তদের তাঁর সামনে বসিয়ে জেরা করা হোক প্রয়োজনে।
এবং সূত্রের খবর, অভিযুক্ত এক ছাত্রের সঙ্গে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যাদবপুরের এক হস্টেল-সুপারকে আজ, বুধবার ডেকে পাঠিয়েছে তদন্ত কমিটি। এ জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আজ দুপুরে অভিযোগকারিণী ও অভিযুক্তদের এক সঙ্গে বসিয়ে কমিটি জেরা করতে পারে।
পাশাপাশি পুলিশও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এ দিন ছাত্রীটির বাবার অফিসে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন কলকাতা পুলিশের দক্ষিণ শহরতলি ডিভিশনের ডিসি সন্তোষ পাণ্ডে। সঙ্গে ছিলেন কলকাতা পুলিশের মহিলা শাখার ডিসি দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায়। অভিযোগকারিণীর যে বন্ধু সে দিন নিগ্রহকারীদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে আহত হন, ডিসি পাণ্ডে তাঁর সঙ্গেও কথা বলেছেন। দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তিনি। পুলিশ-সূত্রের খবর, অভিযুক্ত ছাত্রদের পুলিশও আজ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়েছে।
আজ, বুধবার পুলিশি-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট আদালতে জমা পড়ার কথা। আর সুরঞ্জন কমিটিকে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে হবে কাল, অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের মধ্যে। দায়িত্ব পালনের সূচনায় কমিটি এ দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈঠকে বসেছিল। দুই মহিলা সদস্য বৈঠকের মাঝে বেরিয়ে বেথুন কলেজে গিয়ে কথা বলে আসেন নিগৃহীতার সঙ্গে। সেখান থেকে ফিরে তাঁরা ফের আলোচনায় যোগ দেন। সূত্রের ইঙ্গিত, মেয়েটির অভিযোগে সারবত্তা আছে বলেই কমিটির মনে হয়েছে।
এ দিকে রাজ্যের ওই তদন্ত কমিটির বৈধতা সম্পর্কে ইতিমধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন তো বটেই, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও আইনজীবীদের কেউ কেউ সোমবার অভিযোগ তুলেছেন, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা রোধে ২০১৩ সালে যে আইন প্রণয়ন হয়েছে, সুরঞ্জন-কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি মানা হয়নি। এই মহলের যুক্তি: সংশ্লিষ্ট আইন মোতাবেক কর্মক্ষেত্রে যে কোনও যৌন হেনস্থার তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান করতে হবে এক জন মহিলাকে। উপরন্তু কমিটির অন্তত অর্ধেক সদস্য হবেন মহিলা। অথচ এই কমিটির মাথায় কোনও মহিলা তো নেই-ই, পাঁচ সদস্যের মধ্যে মহিলা সাকুল্যে দু’জন!
সুরঞ্জনবাবু অবশ্য অন্য যুক্তি দিচ্ছেন। তাঁর দাবি “কমিটির সঙ্গে বিশাখা গাইডলাইন বা নতুন কেন্দ্রীয় আইনের সম্পর্ক নেই। এটা একটা প্রাথমিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (তথ্যানুসন্ধানী) কমিটি।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বক্তব্য, “২৮ অগস্ট শ্লীলতাহানির ঘটনাটি ঘটেছে বলে অভিযোগ। অথচ এখনও তার তদন্ত-রিপোর্ট জমা পড়েনি। কিন্তু সরকার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই তারা দ্রুত রিপোর্ট পাওয়ার স্বার্থে এই কমিটি বানিয়েছে।” কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। যাদবপুরের আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা কমিটির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। যার প্রেক্ষাপটে সুরঞ্জনবাবুর আশ্বাস, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত চালিয়ে দ্রুত রিপোর্ট দিতে তাঁরা বদ্ধপরিকর।
কমিটির বৈঠকে এ দিন কী আলোচনা হল?
সদস্যদের কেউ মুখ খুলতে চাননি। যদিও সূত্রের খবর: ২৮ অগস্টের ঘটনা সম্পর্কে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ কমিটি (আইসিসি)-র তদন্ত কতটা এগিয়েছে, নথিপত্র জোগাড় করে তা নিয়ে বৈঠকে কথাবার্তা হয়। প্রসঙ্গত, আইসিসি’র ভূমিকা নিয়ে যাদবপুরের অন্দরেই নানা অভিযোগ। ওই কমিটিতে ছাত্র বা গবেষক থাকেন কী ভাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ সংক্রান্ত নথি কী কী মিলেছে, সুরঞ্জন-কমিটি এ দিন তা যাচাই করেছে। অভিযুক্ত কয়েক জন ছাত্রের নামও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে কমিটিকে জানানো হয়েছে। “অভিযোগের বয়ান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠানো নথিপত্র বিশ্লেষণ করে মোটামুটি পরিষ্কার যে, ওই রাতে অপ্রীতিকর একটা কিছু ঘটেছিল।” মন্তব্য করেছেন কমিটির এক সদস্য। কী রকম অপ্রীতিকর?
ওঁর ব্যাখ্যা, “সেটা যৌন নিপীড়নের হতে পারে। না-ও হতে পারে। তবে কারও হাত ধরে টানাটানি করলেও বিশাখা গাইডলাইন অনুুযায়ী তা শ্লীলতাহানি হিসেবে গণ্য হবে।” ওঁর আশা, অভিযোগকারী ছাত্রী ও অভিযুক্ত ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনাটি তাঁদের কাছে পরিষ্কার হবে। তার পরে তাঁরা নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন।
কিন্তু এমন গুরুতর অভিযোগ পাওয়ার পরেও যাদবপুরের উপাচার্য দ্রুত তদন্তের পথে না-হেঁটে নিগৃহীতার বাবাকে ‘দিন দুয়েক বাদে’ আসার পরামর্শ দিলেন কেন, কমিটিতে সেই প্রশ্ন উঠেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ২৮ অগস্ট ঘটনাটি ঘটার পরে, ১ সেপ্টেম্বর নিগৃহীতার বাবা যাদবপুরের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যান। অভিযোগ, উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী তখনই তাঁকে ওই পরামর্শ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য সূত্রের দাবি, অভিজিৎবাবুর দিন দুয়েকের জন্য রাজ্যের বাইরে যাওয়ার কথা ছিল বলেই তিনি মাঝের সময়টুকু শুধু অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।
ছাত্রীটি অবশ্য উপাচার্যের পরামর্শ মানেননি। ওরই মধ্যে তিনি যাদবপুর থানায় অভিযোগ করেন। আর তাঁর অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ, পুলিশি অভিযানের জেরে উত্তাল হয়ে ওঠে যাদবপুর ক্যাম্পাস। যার আঁচ ছড়ায় রাজ্য-রাজনীতিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy