ঘোষণার দিনেই সংশয় প্রকাশ করেছিল শিল্পমহল। সেটাই কার্যত সত্যি হল।
গত ২৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, ডানকান গোষ্ঠীর সাতটি রুগ্ণ চা-বাগানের পরিচালন ভার হাতে নেবে টি বোর্ড। চা শিল্পের সঙ্গে যুক্তরা তখনই প্রশ্ন তুলেছিলেন, বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশন (বিআইএফআর)-এ যাওয়া একটি সংস্থার অধীনস্থ বাগানের পরিচালন ভার টি বোর্ড কী ভাবে নিতে পারে! সে জন্য তো বিএফআইআর-এর অনুমোদন প্রয়োজন। টি বোর্ডের পক্ষে বাগান চালানো সম্ভব কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছিল।
নবান্ন সূত্র বলছে, বাণিজ্য মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি জারি করার পরের দিনই, অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারি, টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সন্তোষ ষ়ড়ঙ্গী রাজ্যের মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে জানান, ‘‘ডানকানের বাগানগুলির পুনরুজ্জীবনের জন্য বিআইএফআর একটি প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। টি বোর্ড সেই প্যাকেজ থেকে বাগানগুলি বের করে আনার জন্য বিআইএফআরে আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু যত ক্ষণ না এর নিষ্পত্তি হচ্ছে, তত ক্ষণ বাগানগুলি টি বোর্ড হাতে নিতে পারবে না।’’
বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পেয়ে এবং নিজে পর্যবেক্ষণ করে ডানকানের ১৪টি চা-বাগান সম্পর্কে দিল্লিতে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন টি বোর্ডের ডিরেক্টর। মতামত নেওয়া হয়েছিল রাজ্যেরও। দেখা যায় বীরপাড়া, গেরগন্দা, লঙ্কাপাড়া, তুলসীপাড়া, হান্টাপাড়া, ধুমছিপাড়া ও ডিমডিমা— এই সাতটি বাগানের অবস্থা বেশি সঙ্গিন। সেগুলিই হাতে নেওয়ার কথা ঘোষণা করে কেন্দ্র।
কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তাদের বক্তব্য ছিল, বিধানসভা ভোটের আগে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতেই চা-বাগান অধিগ্রহণের ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। শিল্পমহলের অবশ্য বক্তব্য ছিল, রাজনীতি নয়, এর পিছনে রয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নীতিগত অবস্থান। যত দিন যাচ্ছে, ততই ‘বামপন্থী’ মোড় নিচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
এই চাপানউতোরের মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থা অবশ্য হয় চা-বাগানগুলির শ্রমিকদের। কেন্দ্রের ঘোষণার আগে রাজ্যের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, ১ ফেব্রুয়ারি ১৪টি বাগানই খুলবেন ডানকান কর্তৃপক্ষ। তার আগে বকেয়া ১০০ কোটি টাকার মধ্যে ৪০ কোটি মিটিয়ে দেবেন তাঁরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাগান খোলা ও বকেয়া দেওয়া থেকে পিছিয়ে এসে আদালতের দ্বারস্থ হয় ডানকান। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন অভিযোগ করেন, ‘‘বাগান খোলা নিয়ে দিল্লি রাজনীতি করার চেষ্টা করেছিল। এখন নিজেদের জালেই আটকে গিয়েছে। কেন্দ্র পরিচালন ভার নিতে চেয়েছে, মালিকপক্ষ আদালতে গিয়েছে। এই অবস্থায় রাজ্যের কিছু করার নেই। তবে শ্রমিকদের যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা জারি থাকবে।’’ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও দাবি করেন, ‘‘কেন্দ্রকেই এখন শ্রমিকদের পাওনা-গণ্ডা মেটাতে হবে।’’
টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অবশ্য মুখ্যসচিবকে লিখেছেন, ‘‘বিআইএফআরে আবেদন না মেটা পর্যন্ত সরকার ও শ্রমিকদের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি মেনে চলতে হবে ডানকান গোষ্ঠীকে। তাদেরই অবিলম্বে বাগান খুলে বকেয়া মেটাতে হবে। কেন্দ্রের বিজ্ঞপ্তিকে ঢাল করে ডানকান গোষ্ঠী শ্রমিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করতে পারবে না।’’ একই সঙ্গে বোর্ডের দাবি, তারা আদৌ পরিচালন ভার নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। টি বোর্ডের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘বিজ্ঞপ্তি জারি করার পরে পিছিয়ে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি। আমরা বলেছি, বিআইএফআরের অনুমোদন না-মেলা পর্যন্ত বাগান পরিচালনার ভার নেওয়া যায় না।’’ বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক রাহুল সিংহও বলেন, ‘‘ওই সাতটি বাগান কেন্দ্রই চালাবে। সেই কারণেই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এখন আইনি জটিলতা কাটাতে কিছু সময় লাগছে।’’
চা শ্রমিক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চের আহ্বায়ক জিয়াউল আলম আবার রাজ্যের কোর্টে বল ঠেলে বলেছেন, ‘‘মুখ্যসচিব কেন্দ্রকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তার বক্তব্য এমনটাই ছিল। সুতরাং এখন রাজ্যের খুশি হওয়ারই কথা। এ বার পুরনো চুক্তি মেনে বাগান খুলুক রাজ্য।’’ তৃণমূল ছাড়া ২৩টি চা শ্রমিক সংগঠনের যৌথ সংগঠনের আহ্বায়ক জিয়ার আবেদন, শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে যেন টানাটানি শুরু না হয়। কিন্তু জল যে দিকে গড়াল তাতে বাগানগুলির ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল বলেই চা শিল্পমহলের অভিমত।
এ দিকে অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডানকান গোষ্ঠীর মামলা এ দিন হাইকোর্টে উঠলে ব্যক্তিগত কারণে তা শুনতে চাননি বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশ জানান, বিচারপতি দত্ত যখন আইনজীবী ছিলেন, তখন ডানকান গোষ্ঠীর হয়ে মামলা লড়েছেন। তাই নীতিগত কারণেই তিনি এখন মামলাটি শুনতে চান না। এ বার কোন বিচারপতি মামলাটি শুনবেন, তা ঠিক করবেন প্রধান বিচারপতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy