Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

তট-দুর্যোগ মোকাবিলার যুদ্ধে প্রস্তুতই নয় রাজ্য

বিপর্যয়ের ঝাপটা সামলানোর খাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাজেট বরাদ্দ প্রায় চার গুণ বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় শিবির (সাইক্লোন শেল্টার) গড়ার ঘোষণাও করেছেন অর্থমন্ত্রী মিত্র। কিন্তু ঘটনা হল, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সুষ্ঠু ভাবে মোকাবিলা করার আগ্রহ রাজ্য সরকারের আদৌ আছে কি না, এই মুহূর্তে সেই প্রশ্নটাই প্রশাসনের অন্দরে ঘা মারছে। এ হেন সংশয়ের প্রেক্ষাপট গড়ে দিয়েছে খোদ বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

বিপর্যয়ের ঝাপটা সামলানোর খাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাজেট বরাদ্দ প্রায় চার গুণ বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় শিবির (সাইক্লোন শেল্টার) গড়ার ঘোষণাও করেছেন অর্থমন্ত্রী মিত্র। কিন্তু ঘটনা হল, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সুষ্ঠু ভাবে মোকাবিলা করার আগ্রহ রাজ্য সরকারের আদৌ আছে কি না, এই মুহূর্তে সেই প্রশ্নটাই প্রশাসনের অন্দরে ঘা মারছে।

এ হেন সংশয়ের প্রেক্ষাপট গড়ে দিয়েছে খোদ বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট।

কী রকম? সরকারি সূত্রের খবর: সুসংহত উপকূল পরিচালন ব্যবস্থা (ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট, সংক্ষেপে আইসিজেডএম) সংক্রান্ত বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রকল্পটির কাজের গতি ধীর থেকে ধীরতর হচ্ছে। তার অগ্রগতি এতটাই ঢিমে যে, চার বছরে রাজ্য খরচ করতে পেরেছে আড়াই কোটি টাকা, যেখানে বরাদ্দ তিনশো কোটি! প্রকল্প রূপায়ণে দেশের উপকূলবর্তী অন্য দুই রাজ্য, ওড়িশা ও গুজরাতের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ দুস্তর পিছিয়ে।

এ দিকে হাতে রয়েছে মাত্র দশ মাস। অবস্থা দেখে বিশ্বব্যাঙ্কের কর্তারা সন্দিহান, এ রাজ্যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি রূপায়িত হবে কিনা। ওঁদের আশঙ্কা সত্যি হলে উপকূলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকাঠামো গড়ার যাবতীয় ব্যয়ভার একা রাজ্যের ঘাড়ে চাপবে। যেখানে কোষাগারের টানাটানিতে রোজকার খরচ সামলাতে নাভিশ্বাস, সেখানে ওই বাড়তি খরচের বোঝা কী ভাবে সামলাবে, রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা তা ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছেন না।

পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে সমুদ্রের চরিত্র দিন দিন বদলাচ্ছে। ভারত মহাসাগর ও আশপাশে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘আইপিসিসি’-র সর্বশেষ রিপোর্টও একই হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে ২০১০-এ গুজরাত, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলকে ‘বিপর্যয়প্রবণ’ ধরে আইসিজেডএম প্রকল্পের সূচনা। যার আওতায় তট-অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় শিবির তৈরি, এলাকার ভূ-পরিবেশগত চরিত্র বদল সংক্রান্ত গবেষণার জন্য যন্ত্রপাতি কেনা কিংবা জনজীবনের উন্নয়নের মতো একাধিক কাজ হওয়ার কথা। মোট খরচের ৭৭% বিশ্বব্যাঙ্ক জোগাবে, ১৩% কেন্দ্র বহন করবে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশের দায়ভার সংশ্লিষ্ট রাজ্যের। বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী, প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে হবে ২০১৫-র ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। সর্বশেষ রিপোর্টে বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়েছে, সময়সীমা পেরোলে বাদবাকি কাজের টাকার সংস্থান রাজ্যকেই করতে হবে।

এত ঢিলেমি কেন? রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয় শিবির বানাতে কয়েকটা টেন্ডার হয়েছে। টেন্ডার ও প্রযুক্তিগত কিছু বিষয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের সবুজ সঙ্কেত মিললেই কাজ শুরু হবে। এত দিন কিছুটা গড়িমসি হয়েছে বলে স্বীকারও করে নিয়েছেন তিনি।

পরিবেশ দফতরের খবর, গোড়ায় প্রকল্প রূপায়ণের অগ্রগতি দেখে বিশ্বব্যাঙ্ক সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু ’১৩-র মাঝামাঝি নাগাদ কাজে সেই যে ভাটা পড়েছে, বিশ্বব্যাঙ্কের সতর্কবাণীতেও তা শুধরোয়নি। “শুধু আশ্রয় শিবির নয়, অনেক কিছুই কার্যত থমকে গিয়েছে। জোয়ারের জল পরিমাপের ব্যবস্থা হয়নি, আবহাওয়ার পরিবর্তন যাচাইয়ের যন্ত্র বসেনি। নদীর গতিপথ বদল নিয়ে সমীক্ষাও শিকেয়।” আক্ষেপ করছেন পরিবেশ দফতরের এক আধিকারিক।

সঙ্কটের জন্য একাধিক কারণের দিকে আঙুল উঠছে। প্রশাসন ও পরিবেশবিদদের একাংশের বক্তব্য: আইসিজেড রূপায়ণের স্বার্থে প্রযুক্তি-পেশাদার নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। নোডাল এজেন্সি হিসেবে গড়া হয়েছিল ‘স্টেট প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’ (এসপিএমইউ)। কিন্তু প্রশাসনেরই একাংশের হস্তক্ষেপে ইউনিট কার্যত অকেজো হয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ। উপরন্তু দফতরের অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যার জেরে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বহু পেশাদার কর্মী অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছেন। এক পরিবেশ-কর্তার কথায়, “এই ধরনের প্রকল্প রূপায়ণে পেশাদারদের ভূমিকা অনেক বেশি। তাঁদের অভাবে সমস্যা ঘোরালো হয়েছে উঠেছে।”

বিশ্বব্যাঙ্কের এক পরিবেশ-বিশেষজ্ঞের মুখেও একই কথা। তিনি বলছেন, “উপকূল-সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান একবারে সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে এমন সব প্রকল্প কী ভাবে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে, একমাত্র পেশাদার কর্মী-বাহিনীই তার দিশা দিতে পারে। তাই এ ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছিল।” ওঁঁর দাবি, পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে থাকলেও ওড়িশা-গুজরাত এ ক্ষেত্রে অনেকটা সফল। সেখানে রাজ্য উপকূল পর্ষদ গড়ে তোলা হয়েছে, যার মূল চালিকাশক্তি এসপিএমইউ।

তা হলে পশ্চিমবঙ্গে উপকূলীয় পরিবেশরক্ষা উদ্যোগের ভবিষ্যৎ কী?

প্রকল্প-অধিকর্তা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, “সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলি না।” পরিবেশ দফতরের এক শীর্ষ আধিকারিক অবশ্য বলেছেন, “আমরাও বুঝেছি, কাজ সময়ে শেষ হবে না। নানা দফতর আলাদা আলাদা ভাবে যতটা সম্ভব চেষ্টা করছে।”

তাতেও কাজের কাজ কতটা হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE