Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

তৃণমূলের হাঁড়ি-পালায় এ বার ঠমক-নাচ

সাদা জমিতে লাল বুটির ঢাকাই জামদানি। আটপৌরে করে পরা। সঙ্গে ম্যাচিং লাল সিল্কের ব্লাউজ। কপালে লাল টিপ! স্ক্রিপ্টের জন্য যেমনটা প্রয়োজন, ঠিক তেমনই সেজে এসেছিলেন অভিনেত্রী মুনমুন সেন! থুড়ি, বাঁকুড়ার সাংসদ শ্রীমতি সেন। তবু পরিচালকের (পড়ুন দলের) নির্দেশ মতো সওয়া দশটায় পৌঁছতে না পেরে শট্টা মিস করলেন! ভারী আফসোস। লোকসভায় বসলেন গোমড়া মুখ করে!

হাঁড়ি কাঁখে তৃণমূল সাংসদ মুমতাজ সঙ্ঘমিতা। পাশে সৌগত রায় ও ইদ্রিশ আলি। শুক্রবার। ছবি: পিটিআই।

হাঁড়ি কাঁখে তৃণমূল সাংসদ মুমতাজ সঙ্ঘমিতা। পাশে সৌগত রায় ও ইদ্রিশ আলি। শুক্রবার। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৪
Share: Save:

সাদা জমিতে লাল বুটির ঢাকাই জামদানি। আটপৌরে করে পরা। সঙ্গে ম্যাচিং লাল সিল্কের ব্লাউজ। কপালে লাল টিপ!

স্ক্রিপ্টের জন্য যেমনটা প্রয়োজন, ঠিক তেমনই সেজে এসেছিলেন অভিনেত্রী মুনমুন সেন! থুড়ি, বাঁকুড়ার সাংসদ শ্রীমতি সেন। তবু পরিচালকের (পড়ুন দলের) নির্দেশ মতো সওয়া দশটায় পৌঁছতে না পেরে শট্টা মিস করলেন! ভারী আফসোস। লোকসভায় বসলেন গোমড়া মুখ করে!

চিত্র সাংবাদিকদের আফসোস আরও বেশি। এই সাজে কাঁখে হাঁড়ি নিয়ে দাঁড়ালে কী লাগতো ওঁকে! সংসদে এমন মুহূর্ত কী বারবার আসে?

তবে এক্কেবারে খালি হাতে ফিরতে হল না! ওঁরা ছবি পেলেন! কিন্তু মুখটা অন্য। তৃণমূল সাংসদ মুমতাজ সঙ্ঘমিতা! পেশাগত ভাবে এক সময়ে চিকিৎসক ছিলেন। আজ উনিও আটপৌরে করে শাড়ি পরে এসেছিলেন। একটি হাঁড়ি নিলেন কাঁখে। অন্যটি মাথায়। পাশ থেকে সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সৌগত রায় বলে উঠলেন “ও তো গাঁয়ের মেয়ে। কেমন ঠমক ঠমক করে নাচছে দেখুন!” মুমতাজকে একা মাঠের দখল নিতে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইদ্রিশ আলি। দু’দিন আগে লোকসভায় উলু দিয়ে বুঝিয়েছেন, রাজনীতি করার পাশাপাশি ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি’তেও তিনি কম যান না। আজ মুমতাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোমর দোলালেন তিনিও। গত শীতে সাংসদ ও সাংবাদিকদের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচে উইকেট কিপার ছিলেন ডেরেক ও’ব্রায়েন। আজ শীতের সকালে বলের বদলে হাঁড়ি লুফে কিছুটা প্র্যাকটিস সেরে নিলেন তিনিও। আর ‘হাঁড়ি বিক্ষোভ’ পালা সফল ভাবে মঞ্চস্থ করার দায়িত্ব যাঁকে দেওয়া হয়েছিল, সেই কাকলি ঘোষ দস্তিদারের হাঁড়ি কখনও মাথায়, কখনও বা ঘাড়ে। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুলতান আহমেদের মতো বর্ষীয়ান সাংসদেরা অবশ্য হাঁড়ির পরিবর্তে ব্যানার দিয়েই প্রতিবাদ সেরেছেন। সব কিছু দেখে আন্দামানের বিজেপি সাংসদ বিষ্ণুপদ রায় মুচকি হেসে বললেন, “অভাব রইল শুধু ব্র্যাকগ্রাউন্ডে ‘বালা নাচো তো দেখি’ গোছের কোনও গানের!”

রঙ্গমঞ্চ ভাবলে ভুল করবেন। লোকেশন সংসদ ভবন চত্বর। খাস গাঁধী মূর্তির সামনে। এ সপ্তাহে তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষোভের ট্রিলজির আজ ছিল শেষ পর্ব! এই ছাতা-শাল-হাঁড়ি কাণ্ডের পরে তৃণমূলের ‘কালো প্রতিবাদ’ নিয়ে যারপরনাই হাসাহাসি শুরু হয়ে গিয়েছে অন্য দলের সাংসদদের মধ্যে। সকলেই প্রশ্ন তুলছেন, সংসদে নাচানাচি করে, কোমর দুলিয়ে এ কেমন বিক্ষোভ?

দলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের যুক্তি, “মা-মাটি-মানুষের আন্দোলনকে নিয়ে তির্যক মন্তব্য করছে সংবাদমাধ্যম। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কেন্দ্রে মোদী সরকার গঠনের পরে একশো দিনের কাজে বরাদ্দ ছাঁটা হয়েছে। গাঁ-গঞ্জের গরিব গুর্বো মানুষ খেতে পাচ্ছেন না। হাঁড়িতে চাল জুটছে না। তা বোঝাতেই শূন্য মাটির হাঁড়ি নিয়ে আজ ছিল প্রতীকি বিক্ষোভ। তাকে খাটো করা ঠিক হচ্ছে না।”

এই কোমর দোলানো বিক্ষোভ কি তৃণমূলনেত্রী দেখছেন? ওঁর এতে সায় আছে? জানা যায়নি।

তবে অতীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও লোকসভায় কম বিক্ষোভ দেখাননি। কখনও স্পিকারের চেয়ারের দিকে কাগজ ছিঁড়ে ছুড়েছেন। কখনও বা শাল ছুড়েছেন। তার পর কেঁদেও ফেলেছেন। তা নিয়ে তখন সমালোচনাও কম হয়নি। কিন্তু রাজনীতিকরাই স্বীকার করছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের অপশাসনের’ দিকে দিল্লির দৃষ্টি টানার জন্য মমতার সেই বিক্ষোভ দেখানোর মধ্যে আকুতি ছিল। কিন্তু আজ? প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বললেন, “তৃণমূলের সাংসদরা সংসদে এখন যা করছেন, তাতে বাংলার মানুষের লজ্জা হচ্ছে। বাংলার মান সম্মান নষ্ট হচ্ছে। চুরি ঢাকতে রোজ একটা করে নাটক করছেন সাংসদরা। শূন্য পাত্রের আওয়াজ বেশি হয় তা বোধহয় ভুলে গিয়েছে তৃণমূল।” বিজেপি সাংসদ অনুরাগ ঠাকুরের মন্তব্য “টোটাল ড্রামা! বাংলার লক্ষ লক্ষ মা-মানুষের তিল তিল করে জমানো টাকা লুটে নিয়ে তৃণমূলের নেতারাই তাঁদের পথে বসিয়েছেন। এখন নিজেরা পথে বসে সাধু সাজছেন।”

এই রাজনৈতিক প্রতি-আক্রমণ প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার, দুই সভা মিলিয়ে তৃণমূলের চল্লিশ জনের বেশি সাংসদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, সপ্তাহান্তের ছুটিতে “দিদি এ বার কি টাস্ক দেবেন?” দলের এক সাংসদ বলেন, এ যেন ‘যেমন খুশি সাজো’ চলছে। আগের দিন রাতে জানা যাচ্ছে, পর দিন সকালে কোন ভূমিকায় নামতে হবে। ছাতা জোগাড় করেছিলেন ডেরেক। শালের দায়িত্বে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। আর গতকাল হাঁড়ি জোগানের দায়িত্ব পড়ে কাকলির উপর। দিল্লিতে মাটির হাঁড়ি মেলা ভার। তায় এতগুলো! হাঁড়ি খুঁজতে রাতে লোকজন ছোটে করোল বাগ, চিত্তরঞ্জন পার্কের মতো বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়। দলের আর এক সাংসদ মজা করে বললেন, গতকাল কালো শালের আইডিয়াটা খারাপ ছিল না। দিল্লির সরকারি বাসভবনে কোনও কালো শাল রাখা ছিল না। একটা প্রাপ্তি হল। তৃণমূলের অন্য এক সাংসদ কালকের শালটি সংসদের সেন্ট্রাল হলের এক কর্মীকে ‘ভালো মনে’ দান করেছেন। কিন্তু আজ তাঁকে সতীর্থ সাংসদ বলেন, পরদিন যদি ফের দিদি শাল গায়ে আসতে বলেন, কী করবেন? “এই রে, এটা তো মাথায় আসেনি” উক্তি সেই সাংসদের।

পরে লোকসভায় তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কে কী বলছে তাতে কিছু যায় আসে না। দল বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে। আগামী সপ্তাহে একশো দিনের কাজের বরাদ্দ কম করা নিয়ে আলোচনার জন্য দাবি জানানো হয়েছে।” তৃণমূলের আরও অভিযোগ, বিজেপি গোটা দেশে বিষ ছড়াচ্ছে। রাজ্যে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে। সোমবার থেকে সেই সব বিষয় নিয়েও সংসদে সরকারকে চেপে ধরা হবে। ডেরেক বলেন, “এ জন্য রাজ্যসভায় দৃষ্টি আকর্ষণ প্রস্তাব আনা হবে। লোকসভাতেও তা উত্থাপন করবে দল। এ ব্যাপারে দেশের কম বেশি সব ধর্মনিরপেক্ষ দলের সমর্থন তৃণমূলের সঙ্গে রয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tmc parliament
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE