Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দিল্লিকে সহযোগিতার বার্তা মমতার, রাজি প্রধানমন্ত্রীও

মুখ্যমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন, কলকাতায় গেলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের গ্রেফতার করতে পারেন তিনি! এ অবস্থায় কী করা যায়? কলকাতায় কি যাওয়া উচিত, নাকি পূর্বনির্ধারিত সফরসূচি বাতিল করে দেওয়াই ভাল? উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সম্প্রতি এই প্রশ্ন করেন কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী।

দিল্লিতে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি মমতা। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

দিল্লিতে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি মমতা। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৮
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন, কলকাতায় গেলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের গ্রেফতার করতে পারেন তিনি! এ অবস্থায় কী করা যায়? কলকাতায় কি যাওয়া উচিত, নাকি পূর্বনির্ধারিত সফরসূচি বাতিল করে দেওয়াই ভাল?

উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সম্প্রতি এই প্রশ্ন করেন কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী।

প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র জানাচ্ছে, গডকড়ীকে সফর বাতিল করতে বারণই করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মোদী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের প্রশ্নটির সঙ্গে সারদা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তের সম্পর্ক নেই। তৃণমূল ও বিজেপি-র মধ্যে রাজ্য স্তরে সংঘাতের আবহ যাই হোক, তার জন্য রাজ্যে জাতীয় সড়কের কাজ ব্যাহত হবে কেন? রাজ্যগুলিকে বাদ দিয়ে তো দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়!

অতএব ২১ ডিসেম্বর গডকড়ী কলকাতা যাচ্ছেন। ২৩ ডিসেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বৈঠক হবে। গডকড়ী বলেন, “মূলত জাতীয় সড়ক ও রাজ্যের নানা রাস্তা তৈরির প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলতে চাই। কারণ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ ও করিডর নির্মাণের কাজ জমি অধিগ্রহণ সমস্যায় বন্ধ রয়েছে। জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করা রাজ্যের দায়িত্ব। সে জন্যই এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইব।”

মমতা নিজেও এখন বলেছেন, “কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাই। রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে আলোচনা করতে কোনও আপত্তি নেই। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযুষ গোয়েল, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান এর আগে আমার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।” কাজেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কলকাতায় এলে যে গ্রেফতার করা হবে না সেই নিশ্চয়তা দিচ্ছেন মমতা। সূত্রের খবর, গত কালও অরুণ জেটলির সঙ্গে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের কথা হয়েছে। জেটলিও শীঘ্রই পশ্চিমবঙ্গে যেতে পারেন।

এ দিকে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রকে সিবিআই গ্রেফতার করার পর তৃণমূল এখন কলকাতা ও দিল্লিতে আরও আক্রমণাত্মক। কলকাতায় রাস্তায় নেমেছেন মমতা। সংসদে শুধু সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে নয়, বিমা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছে তৃণমূল। জেটলির বিরুদ্ধে অধিকার ভঙ্গের নোটিস দেওয়ার ক্ষেত্রেও মমতার দল অন্য অ-বিজেপি দলগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তীব্র বিরোধিতার লাইন নিয়েছে।

গত কাল মমতা দিল্লি এসেছেন। অসুস্থ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করার পাশাপাশি মমতা আজ গিয়েছিলেন সংসদের সেন্ট্রাল হলেও। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রাথমিক ভাবে অরুণ জেটলিকে বেছেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তবে জিএসটি নিয়ে তৃণমূলের আপত্তির কথা মাথায় রেখে স্থির হয়, কথা বলবেন বেঙ্কাইয়া নায়ডু। তিনি ছাড়া বিজয় গোয়েল, জয়া বচ্চন, প্রফুল্ল পটেলের সঙ্গেও এ দিন কথা হয় মমতার। ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ হওয়ার কথা ভারতে। সে জন্য আজ কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়াম সংস্কারের প্রস্তাব মমতাকে দেন এআইএফএফ সভাপতি প্রফুল্ল পটেল। মমতা রাজি। ২৪ তারিখ কলকাতায় যাবেন প্রফুল্ল।

বেঙ্কাইয়া জানান, কিছু প্রশাসনিক বিষয়ে কথা বলতে তিনিও শীঘ্র কলকাতায় যাচ্ছেন। মমতা হেসে তাঁকে জানান, বেঙ্কাইয়া যদি রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও কথা বলেন, সমস্যা নেই। তিনি কথা বলবেন। বেঙ্কাইয়াও তাতে সায় দেন।

কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতার এই আবহে সারদা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তের বিষয়ে মমতা যে আক্রমণাত্মক কৌশল নিয়েছেন সেটা কি অব্যাহত থাকবে? মমতা নিজে বলছেন, “রণে ভঙ্গ দেব না। প্রয়োজনে দিল্লি এসে ধর্না দেব। তবে সেটা কবে থেকে করব, কত দিন ধরে করব, সেটা হিসেব করেই ঠিক হবে।” দলের সাংসদদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন মমতা। অনেকের মত, দিল্লিতে প্রকাশ্য সংঘাতে না গিয়ে আন্দোলনকে রাজ্য স্তরে রাখাটাই ভাল। তাঁর কথাতেই স্পষ্ট, মমতা নিজেও এখন বিষয়টি নিয়ে পা মেপে এগোতে চাইছেন।

বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ কিন্তু রাজ্যে তৃণমূল-বিরোধী লড়াইয়ে ক্ষান্তি দিতে চান না। ২০১৫ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের পর্ব শুরু। প্রথমে কলকাতা পুর নির্বাচন, তার পর জেলাওয়াড়ি ৪৪টি পুরসভার ভোট। তার পর ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচন। কাজেই রাজ্য বিজেপিকে রাশ টানার কোনও কারণ দেখছেন না অমিত। তাঁর কথায়, “বিজেপি রাজ্যে বিরোধী দল। তা ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেস এনডিএ-র শরিকও নয়। কাজেই লড়াই ছাড়ার প্রশ্নই নেই।”

প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকাটা কাম্য নয়। মোদী বলেন, “আমার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যর সঙ্গেই মমতার যোগাযোগ রয়েছে। ওঁর সঙ্গে বৈঠকে বসতে আমারও কোনও আপত্তি নেই। বরং সেটা আমার দায়িত্ব!” প্রধানমন্ত্রীর কথায়, সিবিআই তদন্ত ভার নিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। স্বাধীন ভাবেই তারা কাজ করছে।

বস্তুত সারদা কেলেঙ্কারির দায়িত্বে থাকা অফিসার অনিল সিনহাকে সিবিআইয়ের প্রধান করার ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী তাঁর সতীর্থদের বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও লোকপাল বিল অনুসরণ করেই এই নিয়োগ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত পছন্দ বা কাউকে বিপদে ফেলাটা উদ্দেশ্য নয়।

দিল্লি সফরে আসা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সম্মানে নৈশভোজে মমতাকেও আমন্ত্রণ করেছেন প্রণববাবু। এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য দিল্লিতে থাকার মেয়াদ আরও এক দিন বাড়িয়েছেন মমতা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও এই নৈশভোজে থাকার কথা। সে হিসেবে খানিকটা সহসাই মোদী-মমতা মুখোমুখি হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার আগরতলায় বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে সাদরে আমন্ত্রণ জানান, রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসারও অনুরোধ জানান মোদীকে। রাজ্য সরকার প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে যে ভাবে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে, তা দেখে মোদী মুগ্ধ। এক জন বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রীর এই কাজ বস্তুত মোদীর কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল। মানিক নিজেও বলেছেন, কেন্দ্রের ‘জনবিরোধী’ নীতিগুলির বিরুদ্ধে তাঁদের আন্দোলনে কোনও খামতি থাকবে না। কিন্তু রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে কেন্দ্র ও প্রধানমন্ত্রীকে পাশে নিয়েই তিনি চলতে চান।

মানিকের এই প্রয়াসকে মমতা ব্যঙ্গ করলেও মোদী চাইছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গেও এই সম্পর্কই গড়ে উঠুক। এমনকী তিস্তা ও স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পরে মমতা ও মানিককে সঙ্গে নিয়েই মোদী ঢাকা সফরে যেতে চান। মমতা এ দিন জানিয়েছেন, কেন তিনি স্থল সীমান্ত চুক্তিতে সায় দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য, এর আগে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে এগোনো হয়নি। কিন্তু কেন্দ্রের নয়া সরকারের সচিবরা কলকাতায় গিয়ে পুনর্বাসন নিয়ে আলোচনা করে গিয়েছেন। তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কল্যাণ রুদ্র কমিটির রিপোর্ট পেলে আমরা সে ব্যাপারটিও ভাবনাচিন্তা করব।” যদিও নবান্ন সূত্রের খবর, মমতার নির্দেশেই কাজ বন্ধ করেছেন নদী বিশেষজ্ঞ।

মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রের সঙ্গে বিষয় ভিত্তিক সমর্থন বা বিরোধিতার পথে হাঁটতে চান তিনি। আর মোদী চাইছেন, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক আর রাজ্য-রাজনীতি দুটি বিষয় পৃথক থাক। কিন্তু প্রশ্ন হল, সিবিআই তদন্ত নিয়ে মমতার কেন্দ্র-বিরোধী আক্রমণের পরে কি সেই আবহ তৈরি হতে পারে?

মমতা বলেন, “নৃপেন মিশ্রকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি করার জন্য অর্ডিন্যান্স জারির সময়ে তৃণমূল রাজ্যসভায় কেন্দ্রকে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু মুখে সংবিধানের কথা বললেও বাস্তবে সিবিআই নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। আমাদেরও তাই রাস্তায় নামতে হয়েছে।”

অমিত শাহ অবশ্য বলেন, “রাজনীতি ও প্রশাসনের বিষয়টি মমতা গুলিয়ে ফেলছেন। মমতা একশো বার মোদীর সঙ্গে বৈঠক করুন। কিন্তু আমি দলের সভাপতি। রাজ্যে বিরোধী দল বিজেপি।

মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই কি আমাদের কর্তব্য নয়?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE