Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নয়াচরে সৌর বিদ্যুৎ তৈরির প্রস্তাব প্রসূনের, রাজি কেন্দ্র

পেট্রো-রসায়ন তালুক হয়নি। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রও নয়। এ বার সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার চেষ্টা শুরু হল নয়াচরে। গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন লন্ডনে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ টানার চেষ্টা করছিলেন, সেই একই সময় দিল্লিতে বসে নয়াচর নিয়ে কথাবার্তা এগিয়েছেন অনাবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

পেট্রো-রসায়ন তালুক হয়নি। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রও নয়। এ বার সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার চেষ্টা শুরু হল নয়াচরে।

গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন লন্ডনে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ টানার চেষ্টা করছিলেন, সেই একই সময় দিল্লিতে বসে নয়াচর নিয়ে কথাবার্তা এগিয়েছেন অনাবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়। সেখানে ১২০০ মেগাওয়াটের একটি ‘সোলার পার্ক’ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। নরেন্দ্র মোদীর সরকারও জানিয়ে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের বিষয়ে তারা রাজ্যের পাশে দাঁড়াতে তৈরি। তাই নয়াচরে সোলার পার্ক তৈরির ক্ষেত্রে কেন্দ্র সব রকম সাহায্য করবে। রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মনীশ গুপ্ত এ ব্যাপারে উৎসাহই দেখিয়েছেন বলে প্রসূনবাবুর দাবি।

নয়াচরে ঠিক কী করার চেষ্টা চলছে?

প্রসূনবাবুর ইউনিভার্সাল সাকসেস গোষ্ঠী সেখানকার ৬০০০ একর জমিতে একটি সোলার পার্ক তৈরির মূল পরিকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর জন্য খরচ হবে ৫৫০ কোটি টাকা। এর পরে সেখানে বিভিন্ন সংস্থাকে পরিবেশ-বান্ধব সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য নিয়ে আসা হবে। প্রসূনবাবু বলেন, ‘‘নয়াচরে এই সোলার পার্ক বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৮৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থানও হবে।’’ এর পাশাপাশি নয়াচরকে একটি পর্যটনস্থল হিসেবে গড়ে তোলারও পরিকল্পনা রয়েছে। তাতেও বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।

নয়াচরকে ঘিরে পরিকল্পনা তো আগেও হয়েছে। কিন্তু দু’বারই ভেস্তে গিয়েছে সব। নয়াচরের নিচু জলাজমি উঁচু করার খরচখরচা সামলে আদৌ লাভজনক প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব কি না সেই প্রশ্ন ছিলই, পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিও বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে সময় বলা হয়েছিল, পেট্রো-রসায়ন তালুক হলে তার বর্জ্য এলাকার জৈব-পরিবেশ নষ্ট করবে, রুজিতে টান পড়বে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের। পরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগ শুরু হলে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নয়াচরের ভৌগোলিক অবস্থান। দ্বীপের সিংহভাগ এলাকাই উপকূল নিয়ন্ত্রণ বিধির তথা ‘কোস্টাল রেগুলেটরি জোন’-এর আওতায় পড়ে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কী ভাবে পৌঁছবে, এবং তা খরচে পোষাবে কি না, সেই ভাবনা তো ছিলই, তার সঙ্গে ওঠে পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নও। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই দূষণ ঘটাবে, এমন আশঙ্কাও ছিল। ফলে পরিবেশ মন্ত্রকের তরফে বারবার আপত্তি আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায় সেই উদ্যোগও। আশার কথা এটাই যে, পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পাওয়ার সমস্যা থাকবে না সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রে। এবং সে কথা মাথায় রেখেই নয়াচরের ওই জমিতে এ বার সোলার পার্ক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের সংস্থা ইউনিভার্সাল সাকসেস গোষ্ঠী। অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রকের সচিব উপেন্দ্র ত্রিপাঠীও প্রসূনবাবুকে বৈঠকে জানিয়েছেন, নয়াচরে সোলার পার্ক হলে পরিবেশ বা উপকূলবর্তী এলাকা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কোনও সমস্যা হবে না।

মোদী সরকারের নিজস্ব লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রেও ইউনিভার্সাল সাকসেসের এই প্রস্তাবটি বেশ সময়োপযোগী। কারণ, ২০২২-এর মধ্যে অপ্রচলিত উৎস থেকে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে সরকার। এর মধ্যে সৌর বিদ্যুতের পরিমাণ হবে ১ লক্ষ মেগাওয়াট। অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘ওই সোলার পার্ক সরকারের সেই লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করবে।’’ নয়াচরের প্রতি বর্গমিটার জমি বছরে ১৭০০ কিলোওয়াট সৌর বিকিরণ পায়। দৈনিক হিসেবে প্রতি বর্গমিটারে ৫.১১ কিলোওয়াট। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প লাভজনক হওয়ার জন্য ন্যূনতম যতটা দরকার, এটা তার তুলনায় যথেষ্ট বেশি।

অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গ অপ্রচলিত উৎস থেকে বিদ্যুৎ তৈরির ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল। কিন্তু এখন তারা দেশের প্রথম দশটি রাজ্যের মধ্যেই নেই। অপ্রচলিত বিদ্যুৎ তৈরির ক্ষেত্রে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্র, এমনকী ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার মতো রাজ্যগুলিও অনেক এগিয়ে গিয়েছে। পূর্ব ভারতের উন্নয়ন ঘটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মোদী সরকার তাই নয়াচরে সোলার পার্ক তৈরির ক্ষেত্রে সবরকম সাহায্য করতে চাইছে। অপ্রচলিত শক্তি যুগ্ম-সচিব তরুণ কপূর বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন।

পশ্চিমবঙ্গে নতুন শিল্প বা উদ্যোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে যে খরা চলছে, তার মধ্যে প্রসূনবাবুদের এই প্রস্তাবে রাজ্য সরকারও উৎসাহিত। অপ্রচলিত উৎস থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে উৎসাহ দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন রকম প্রকল্প রয়েছে। সেগুলির সুবিধা কী ভাবে নেওয়া যায়, তা দেখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সোলার পার্কের পাশাপাশি নয়াচরকে পর্যটন গন্তব্য হিসেবেও তুলে ধরা সম্ভব বলে মনে করছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। পর্যটন মন্ত্রকের সচিব ললিত পানওয়ার জানান, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাব এলে তিনি খতিয়ে দেখতে তৈরি। এ জন্য নয়াচরে তিনটি জেটি তৈরি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য করতে রাজি হয়েছে জাহাজ মন্ত্রক। মন্ত্রকের যুগ্ম-সচিব আর কে অগ্রবাল জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে জাহাজ মন্ত্রক সাহায্য করতে পারে।

তবে প্রকল্পটি রূপায়ণের ক্ষেত্রে সমস্যাও রয়েছে কিছু। সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল, নয়াচরে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎকে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে এসে মূল গ্রিডে সংযুক্ত করা। এ ক্ষেত্রে নদীর জলের ভিতর দিয়ে কেব্‌লের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নিয়ে আসার কথা ভাবা হচ্ছে। আর এক বড় সমস্যা, কার্যত জলাভূমি নয়াচরকে বিদুৎ প্রকল্প গড়ার উপযোগী করে তোলা। প্রসূনবাবুর প্রস্তাবিত ৫৫০ কোটি টাকায় আদৌ মূল পরিকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে শিল্প মহলে প্রশ্ন রয়েছে। প্রসূনবাবুদের বক্তব্য, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে জমি যতটা উঁচু করতে হয়, এ ক্ষেত্রে ততটা করার দরকার পড়বে না। কাঠামোর উপরে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বসবে শুধু। সেই অনুযায়ীই হিসেব কষা হয়েছে। তবে সোলার পার্কের পরিকাঠামো গড়ার পরে শেয পর্যন্ত কারা সেখানে বিদ্যুৎ তৈরির কেন্দ্র গড়তে এগিয়ে আসবে, সে প্রশ্ন থাকছেই।

আর এক সমস্যা বিদ্যুতের দাম। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, অপ্রচলিত উৎস থেকে তৈরি বিদ্যুতের ২০ শতাংশ রাজ্য সরকারকে কিনে নিতে হবে। কিন্তু সৌর বিদ্যুতের দাম বেশি। এ ক্ষেত্রে কী ভাবে সমাধানসূত্র বের করা যায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। একটি প্রস্তাব হল, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা হলে ৫.৫০ টাকা দেবে রাজ্য সরকার। বাকিটা কেন্দ্রীয় সরকার দিয়ে দিতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় আমলারা অনেকেই মনে করছেন, মূল কাজকর্ম এগোতে থাকলে, আলোচনা করে এই রকম ছোটখাটো সমস্যাগুলি মিটিয়ে ফেলা যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE