Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
রেশন-রোষ

নাম নেই, কার্ড নেই বহু গ্রাহকের

দিনমজুরি করে সংসার চালান। খাদ্য সুরক্ষা তালিকায় নাম নথিভুক্তির জন্য আবেদনও করেছিলেন। রাজ্য সরকারের আশ্বাস ছিল, কোনও গরিব মানুষ খাদ্য সুরক্ষা তালিকা থেকে বাদ যাবেন না। কিন্তু, মাস ঘুরতে চলল, হাতে আসেনি ডিজিটাল কার্ড। বহু মানুষের আবার তালিকায় নামই ওঠেনি!

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৫
Share: Save:

দিনমজুরি করে সংসার চালান। খাদ্য সুরক্ষা তালিকায় নাম নথিভুক্তির জন্য আবেদনও করেছিলেন। রাজ্য সরকারের আশ্বাস ছিল, কোনও গরিব মানুষ খাদ্য সুরক্ষা তালিকা থেকে বাদ যাবেন না। কিন্তু, মাস ঘুরতে চলল, হাতে আসেনি ডিজিটাল কার্ড। বহু মানুষের আবার তালিকায় নামই ওঠেনি!

এই অবস্থায় পুরনো কার্ড নিয়েই অগত্যা রেশন দোকানে হাজির হয়েছিলেন গড়বেতা ৩ ব্লকের এক গ্রাহক। সেই ডিলার জানিয়ে দেন— পুরনো রেশন কার্ডে নীল-কেরোসিন ছাড়া জুটবে না কিছুই। অভিযোগ, গ্রাহকের সঙ্গে তর্কাতর্কির মাঝেই দোকানে হাজির হয়ে ওই ডিলারকে সপাটে চড় কষিয়ে দেন স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা একা নয়, কার্ড না পাওয়া গ্রাহকদের ‘আবদার’ এবং রেশনের চাল-গম-চিনি দিতে অপারগ ডিলারের এই বচসার ঘটনায় গত তিন-দিনে জড়িয়ে গিয়েছে মুর্শিদাবাদ থেকে উত্তর ২৪ পরগনা, মালদহ থেকে হাওড়া —অন্তত তেরোটি জেলার নাম। তালিকায় শীর্ষে বাঁকুড়া। শুক্রবার, ওই জেলার অন্তত সাতটি জায়গায় রেশন না পাওয়ায় ডিলারদের সঙ্গে ঝামেলার খবর মিলিছে। রাজ্য সরকারের ‘গাফিলতি’তে বারবার গ্রাহক-রোষের মুখে রেশন ডিলারদের পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে অল ইন্ডিয়া ফেয়ার প্রাইস শপ ডিলার্স ফেডারেশন।

এ দিন বাঁকুড়ার শালতোড়ায় পঞ্চানন মুখোপাধ্যায়ের দোকানে বিক্ষোভ দেখান ডিজিটাল কার্ড না পাওয়া গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখান। একই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে, বাঁকুড়া ১ ব্লকের ছাতারকানালি, করণজোড়া, পিয়ারডোবা। সাত বছর আগে, রাজ্য জুড়ে রেশন রোষের সূত্রপাত যেখানে, সেই ইন্দাসের রোল গ্রামেও এ দিন চাল-গমের দাবিতে রেশন দোকান ঘিরে ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বম্ভবর বসু। ছাতারকানালিতে রেশন দোকানে তালাও লাগিয়ে দেন গ্রামবাসীরা।

গ্রামবাসী বলরাম মাঝি বলেন, “দিনমজুরি করে সংসার চালাই। গ্রামে সরকারি চাকরি করে এমন লোক যদি রেশন পায়, আমি পাব না কেন?’’ তালিকায় নাম না থাকা উজ্বল মাঝির ক্ষোভ, “রেশনের সস্তা চাল, গম, চিনিই তো আমাদের ভরসা ছিল। বাজারের দোকান থেকে মোটা টাকা দিয়ে কেনার সামর্থ আমাদের নেই। শুধু কেরোসিন নিয়ে কী হবে? খাব কী? রেশনই তো বন্ধ!’’ তাঁদের নাম প্রাপকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি না করানো পর্যন্ত রেশন দোকান খুলতে দেবেন না—এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ছাতারাকানালির ওই বাসিন্দারা। গ্রামের রেশন ডিলার মানিক গঙ্গোপাধ্যায়ও বলছেন, “নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী ডিজিটাল কার্ড যাঁরা পাননি, সেই সব গ্রাহককে আমরা কেরোসিন ছাড়া চিনি, চাল, বা গম দিতে পারব না। ডিলার হিসেবে সেই নির্দেশ আমি অমান্য করতে পারি না। কিন্তু, গ্রামবাসীদের সে কথা বোঝাবে কে? অগত্যা রোষের মুখে আমরাই পড়ছি।’’

শুধুই খাদ্য সুরক্ষা তালিকায় নাম না ওঠা কিংবা ডিজিটাল কার্ড না পাওয়া নয়, অভিযোগ আছে আরও অনেক। যেমন, নতুন ডিজিটাল রেশন কার্ডে নাম, পদবির অসংখ্য ভুল রয়েছে। তার পাশাপাশি এক এলাকার বাসিন্দাদের রেশন দোকান অন্য এলাকার দোকানের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক কীভাবে এবং কোন দোকান থেকে রেশন সামগ্রী পাবেন তা নিয়ে বিভ্রান্তি চরমে পৌঁছেছে। নতুন কার্ড পেয়েও তাই দিশেহারা হাল রাজ্যের হাজার হাজার গ্রাহকের। বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের খাঁন্দুবালা লোহার যেমন। নতুন রেশন কার্ডে নিজের গ্রামের বদলে ওই বৃদ্ধাকে পাঠানো হয়েছে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের এক ডিলারের কাছে।

বস্তুত, প্রশাসনকে হাতে না পেয়ে এই সব কারণেও রেশন ডিলারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে গ্রাহকদের। ফলে, আবারও একটা রেশন-রোষের আশঙ্কায় রয়েছে রেশন ডিলারদের ওই সর্বভারতীয় সংগঠন। তাদের দাবি, লোক খেপিয়ে বিক্ষোভের পিছনে শাসকদলেরও ভূমিকা আছে। সংগঠনের এক নেতা বলেন, ‘‘এ বার ভোটে ডিজিটাল কার্ড ছিল তৃণমূলের অন্যতম সেরা বাজি। বড় বড় মুখ করে মুখ্যমন্ত্রী-সহ দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, রাজ্যের সব গরিবের মুখে ২ টাকা কেজি দরে চাল তুলে দিচ্ছি। কিন্তু, দিন যত এগোচ্ছে, স্পষ্ট হচ্ছে, সকলের কাছে ডিজিটাল কার্ড পৌঁছে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই জোর করেই পুরনো রেশন কার্ডে চাল-গম বণ্টনের দাবিতে গা জোয়ারি শুরু করেছেন গ্রামবাসী। এতে ইন্ধন থাকছে শাসকদলের কর্মীদের।’’

খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অবশ্য দাবি, তাঁর দলের কেউ ডিলার-হেনস্থার সঙ্গে জড়িত এমন খবর তাঁর কাছে নেই। বরং রাজ্য সরকারের সাফল্যে ‘হিংসা’ করে বিরোধী দলগুলি এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘ভুল তো ভোটার তালিকাতেও অনেক হয়। পরে তা সংশোধনও করা হয়। সেই সুযোগ এ ক্ষেত্রেও রয়েছে। কেউ ত্রুটির আবেদন জানালেই, তা সংশোধন করে দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE