Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নৈশ হানায় শ্লীলতাহানির তদন্তে নামেনি পুলিশ

যাদবপুরে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির যে ঘটনা ঘিরে আন্দোলনের সূত্রপাত, সে সম্পর্কে রাজ্য শিক্ষা দফতর তদন্ত কমিটি গড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। অথচ গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতরে ১৫ জন ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ রুজু হলেও তা নিয়ে তদন্ত এখনও শুরুই করেনি কলকাতা পুলিশ!

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২১
Share: Save:

যাদবপুরে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির যে ঘটনা ঘিরে আন্দোলনের সূত্রপাত, সে সম্পর্কে রাজ্য শিক্ষা দফতর তদন্ত কমিটি গড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। অথচ গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতরে ১৫ জন ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ রুজু হলেও তা নিয়ে তদন্ত এখনও শুরুই করেনি কলকাতা পুলিশ!

উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে ঘেরাও-মুক্ত করতে ১৬ তারিখ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকেছিল। অভিযোগ: আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপরে তারা চড়াও হয়, এবং অরবিন্দ ভবনের বাইরের আলো নিভিয়ে পুলিশ যখন অভিযান চালাচ্ছিল, তখন ১৫ জন ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করা হয়। নিগৃহীতারা এ-ও বলেছেন, ১৭ তারিখ সকালে তাঁরা যাদবপুর থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করতে চাইলে পুলিশ প্রথমে শুধু একটা জিডি (জেনারেল ডায়েরি) করে ছেড়ে দিয়েছিল। “সেই ইস্তক পুলিশ টালবাহানা করে যাচ্ছিল। শেষমেশ গত শুক্র ও সোমবার দু’দফায় এফআইআর নিয়েছে।” সোমবার জানিয়েছেন এক অভিযোগকারিণী। যদিও সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ তাঁদের সঙ্গে এখনও একটি বারের জন্যও কথা বলেনি বলে দাবি করেছেন তাঁরা।

এফআইআরে ওঁরা কী জানিয়েছেন?

প্রতিটি এফআইআরের বয়ান মোটামুটি এক গত ১৬ সেপ্টেম্বর মাঝরাতে উপাচার্যকে উদ্ধার করতে করতে এক দল পুলিশ ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢোকে। ৪০-৫০ জনের দলটিতে কয়েক জনের পরনে উর্দি থাকলেও অনেকে ছিলেন সাদা পোশাকে। কিছু মহিলা পুলিশ দেখা গিয়েছিল, তবে তাঁরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। অভিযোগে ওই ছাত্রীরা বলেছেন, “মূলত পুরুষ পুলিশকর্মীরাই আমাদের মারধর করে। মেয়েদের জামা-কাপড় ধরে টানতে থাকে। অনেকের পোশাক ছিঁড়ে দেওয়া হয়। গায়ে হাত দেয়, এমনকী শ্লীলতাহানিও করে।’

এমন গুরুতর অভিযোগকে পুলিশ কেন গোড়াতেই এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করল না, যাদবপুরের আন্দোলনকারীরা সেই প্রশ্ন তুলেছেন। যার স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি লালবাজারের কোনও কর্তা। শুক্রবার প্রথম এফআইআর নেওয়া হলেও গত তিন দিনে পুলিশ তদন্ত কেন শুরু করতে পারল না?

কলকাতা পুলিশের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “ওই অভিযোগে অভিযুক্ত হিসেবে যাদবপুর থানার ওসি’র নাম রয়েছে। কোনও থানার ওসি-র বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গেলে পুলিশ কমিশনারের মৌখিক অনুমতি লাগে। লালবাজার এখনও সে অনুমতি দেয়নি।” অন্য দিকে অভিযোগকারী ছাত্রীদের দাবি: ১৭ সেপ্টেম্বর সকালে তাঁরা যে জিডি করেছিলেন, সেখানে অভিযুক্ত হিসেবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কলকাতা পুলিশের এক যুগ্ম কমিশনার এবং যাদবপুর থানার ওসি’র নাম ছিল। কিন্তু শুক্র ও সোমবার রুজু করা এফআইআরে অভিযুক্ত হিসেবে এক দল পুলিশের নাম করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও পুলিশ জিডি-র প্রসঙ্গ টেনে তদন্তে টালবাহানা করছে বলে ওঁদের অভিযোগ।

পুলিশ তথা রাজ্য সরকারের এ হেন ‘দ্বিচারিতায়’ আন্দোলনকারী পড়ুয়ারা যারপরনাই ক্ষুব্ধ। পুলিশের কাছে যাঁরা শ্লীলতাহানির নালিশ করেছেন, তাঁদের এক জনের প্রশ্ন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনার তদন্তে কমিটি গড়লেন! কিন্তু ওই ঘটনারই নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলে আন্দোলন করতে গিয়ে যাঁদের শ্লীলতাহানি হল, তাঁদের অভিযোগের তদন্ত কে করবে?” আর এক ছাত্রীর মন্তব্য, “পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়ার ধর্ষণকে মুখ্যমন্ত্রী তো আগেভাগেই ছোট্ট ঘটনার তকমা দিয়ে দিয়েছিলেন! এ ক্ষেত্রে তিনি তদন্ত করতে বললেই বরং আমরা অবাক হতাম।”

কিন্তু এফআইআর হওয়ার পরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বরে ঢুকে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির মতো মারাত্মক অভিযোগের তদন্ত শুরুর নির্দেশ লালবাজার এখনও দিল না কেন?

পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের কাছে জবাব মেলেনি। তিনি এ দিন ফোন ধরেননি, এসএমএসের উত্তর আসেনি। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ও ফোন ধরেননি। কলকাতা পুলিশের নিচুুতলার কয়েক জন অফিসার অবশ্য নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। “গত বৃহস্পতিবার পুলিশ কমিশনার সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, ওই রাতে যাদবপুরের ক্যাম্পাসে পুলিশ সংবেদনশীল আচরণ করেছে। এ বার সেখানে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতে হলে ওঁকে আগের বয়ান বদলাতে হবে। সম্ভবত সেই কারণেই পুলিশ কমিশনার দ্বিধাগ্রস্ত।” বলছে পুলিশের এই মহল।

যাদবপুর ক্যাম্পাসে পুলিশি দমনপীড়নের অভিযোগের তদন্ত শুরু না-হওয়ায় রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু রাজ্য সরকারের কড়া সমালোচনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাজ্যপালের হস্তক্ষেপও চেয়েছেন তিনি। আর এ দিন গোটা ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “পুলিশ অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত রাখছে। দেশে আইন কি এমনি-এমনি হয়েছে? আইন মোতাবেক, শ্লীলতাহানি বিচারযোগ্য অপরাধ। আইনের সে অধিকার মেয়েরা পাবে না কেন?”

পুলিশ কমিশনারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন সুনন্দাদেবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE