এ-ও যেন এক অকালবোধন!
তিথি বলছে, বিসর্জনের লগ্ন আসন্ন। কিন্তু বাস্তবে যেন আবাহনের ঢাকে কাঠি পড়েছে। বাজারে ইলিশের রমরমা দেখে এখন সে রকমই মনে করছেন গড়পড়তা বাঙালি।
অক্টোবরের গোড়া থেকে বাজারে ফিরে এসেছে রুপোলি শস্য। তার নিজস্ব মরসুম বর্ষায় যাকে প্রায় দেখায়ই যায়নি। এ দিকে দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে। আর দশ দিন পরেই বিজয়া দশমী। যে দিন জোড়া ইলিশ কিনে এনে এই পর্যায়ের মতো ওই মাছ খাওয়া থেকে ক্ষান্ত হন বহু বাঙালি। ওই রেওয়াজ অনুযায়ী, সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ কিনে এনে ফের খাওয়া শুরু হবে।
যে ইলিশ এখন মৎস্যপ্রিয় বাঙালির পাতে ফিরে এসেছে, সেগুলো অবশ্য এক কেজি-বারোশো-দেড় কেজি ওজনের নয়। অর্থাৎ, এই সব মাছ থেকে পেটি আর গাদা আলাদা করে কাটার বিলাসিতা করা যাবে না। এখন যে সব মাছ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো স্বাদু হলেও সাড়ে চারশো-পাঁচশো-সাড়ে ছ’শো, বড়জোর সাতশো গ্রামের। কিন্তু তা-ই বা কম কী! সেই জুলাই মাস থেকে এই মাছের জন্যই তো হা-পিত্যেশ করে বসেছিল বাঙালি। দেখা পায়নি।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ইলিশের এই অস্বাভাবিক বেশি জোগান দেখে অবাক মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ী, দু’পক্ষই। দিঘা মৎস্যজীবী সংগঠনের সম্পাদক শ্যামসুন্দর দাস জানিয়েছেন, দিঘার সমুদ্র থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন ২০০-২৫০ টন ইলিশ ধরা হয়েছে। অক্টোবরে ওই তল্লাটে এই পরিমাণ ইলিশ সর্বকালীন রেকর্ড। অথচ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ওই তল্লাটে রোজ ২০০ থেকে ৫০০ কেজির বেশি ইলিশ মিলত না। ডায়মন্ড হারবারের আড়তদার বিজয় সিংহও বললেন, ‘‘ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, নামখানা থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ইলিশ এসেছে দিনে ৯০-১০০ টন। যেখানে জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই সব এলাকা থেকে ইলিশ উঠেছিল দিনে মাত্র ৩০-৪০ টন।’’ রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহও অবাক। বললেন, ‘‘অকালে ইলিশ ধরার ফলে সময়ে ইলিশ আসেনি। আবার অক্টোবরের প্রথম দিকে বাজারে ভালই ইলিশ এসেছে দেখছি।’’
ইলিশের মরসুম কি তা হলে পাল্টে গেল?
রাজ্য সরকারের ইলিশ গবেষণাকেন্দ্রের প্রকল্প অধিকর্তা সপ্তর্ষি বিশ্বাসের কথায়, ‘‘অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এত ইলিশ আসতে পারে, সেটা ভাবাই যায় না।’’ কেন এমন পরিবর্তন? সপ্তর্ষিবাবু মনে করেন, উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইলিশ গতিপথ পরিবর্তন করছে। মৎস্য দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা প্রশান্তকুমার জানাও বলছেন, ‘‘সবটাই উষ্ণায়নের প্রভাব। তাপমাত্রার হেরফেরে সমুদ্রের চরিত্র বদলাচ্ছে। ঋতুর সময়কালেরও পরিবর্তন হচ্ছে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘আজ থেকে দশ বছর আগে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তাপমাত্রা যথেষ্ট কম থাকত। এখন গরম ঠেকাতে এসি চালাতে হয়। ইলিশ বর্ষার মাছ, এই তকমাও হয়তো মুছে যাবে। এমন দিন আসবে, যখন শীতকালে বাঙালির পাতে প্রচুর ইলিশ পড়বে।’’ রাজ্যের প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিপুলকুমার দাসও বলেন, ‘‘আবহাওয়ার ঘন ঘন পরিবর্তনে ইলিশের আচরণেও বদল হচ্ছে।’’
তবে কাকদ্বীপের মৎস্যজীবী শ্যামল দাসের ব্যাখ্যাটা একটু আলাদা। তাঁর মতে, ইলিশ এই সময়ে ডিম পাড়ায় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। তাই সেখানকার গভীর সমুদ্রের মাছ পশ্চিমবঙ্গের উপকূল বরাবর উঠে আসে। শ্যামলবাবুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘এ বছর অতিবৃষ্টির ফলে ওড়িশার মহানদী, সুবর্ণরেখা, বৈতরণী ও ব্রাহ্মণী নদীর জল উপচে পড়েছে। সেই জন্য স্রোতের বিপরীতে নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উঠে আসছে।’’
কারণ যাই হোক, খুশি সকলেই। নিউ মার্কেটের মাছ ব্যবসায়ী নব ঘোষের মন্তব্য, ‘‘এই শেষ বেলায় ইলিশ আসায় আমাদের মুখে হাসি ফুটল।’’ গড়িয়াহাটের মাছ ব্যবসায়ী শ্যামল কর্মকারও বলছেন, ‘‘অক্টোবরে এত ইলিশ আসতে পারে, তা আগে দেখিনি।’’
তবে টালিগঞ্জের কাকলি সমাদ্দারের গলায় আক্ষেপের সুর— ‘‘ইশ্, আমাদের বাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী, বিজয়া দশমীর পর তো ইলিশ আর খাওয়াই যাবে না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy