Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পালাবদলের গন্ধেই সমৃদ্ধির রকেটে উড়ান শুরু সারদার

কার্যত শূন্য থেকে শুরু করে একেবারে সমৃদ্ধির চুড়োয়। যে পথ অতিক্রম করতে সাধারণত দীর্ঘ কাল লাগে, সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন তা পেরিয়ে এসেছিলেন মাত্র চার বছরে! ওই সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সারদার লগ্নি-কারবার প্রায় ৬ হাজার শতাংশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল বলে রিপোর্টে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)। আর এই অবিশ্বাস্য বৃদ্ধির রথে সুদীপ্ত সেন যখন সওয়ার হন, ঘটনাচক্রে তখনই এ রাজ্যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পালে জোর বাতাস লেগেছে। এসএফআইও-র পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল যত ক্ষমতাশালী হয়েছে, ততই বেড়েছে সারদার ব্যবসা। কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আগে পর্যন্ত সারদার সেই ঊর্ধ্বগতি বজায় ছিল।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৫২
Share: Save:

কার্যত শূন্য থেকে শুরু করে একেবারে সমৃদ্ধির চুড়োয়। যে পথ অতিক্রম করতে সাধারণত দীর্ঘ কাল লাগে, সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন তা পেরিয়ে এসেছিলেন মাত্র চার বছরে! ওই সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সারদার লগ্নি-কারবার প্রায় ৬ হাজার শতাংশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল বলে রিপোর্টে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)।

আর এই অবিশ্বাস্য বৃদ্ধির রথে সুদীপ্ত সেন যখন সওয়ার হন, ঘটনাচক্রে তখনই এ রাজ্যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পালে জোর বাতাস লেগেছে। এসএফআইও-র পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল যত ক্ষমতাশালী হয়েছে, ততই বেড়েছে সারদার ব্যবসা। কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আগে পর্যন্ত সারদার সেই ঊর্ধ্বগতি বজায় ছিল। এই তথ্যটিকে নেহাত কাকতালীয় হিসেবে মানতে নারাজ ইডি বা সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা।

কেন্দ্রীয় কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের অধীনস্থ এসএফআইও-ও সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে নিজেদের মতো তদন্ত চালিয়েছিল। সম্প্রতি তারা মন্ত্রকে সাড়ে পাঁচশো পাতার রিপোর্ট পেশ করেছে, যা আনন্দবাজারের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সারদার আমানত সংগ্রহে প্রবল জোয়ার আসে ২০০৯-’১০ অর্থবর্ষে। পরবর্তী দু’বছরে তা প্রায় সুনামিতে পরিণত হয়। ২০১৩-র এপ্রিলে সারদা ঝাঁপ গুটোয়। তার আগের বছরেও সুদীপ্ত সেন বাজার থেকে নয় নয় করে ৭৩৪ কোটি টাকা ঘরে তুলেছিলেন!

এসএফআইও-রিপোর্ট অনুযায়ী, সারদা পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোট ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা তুলেছিল। যার প্রায় দু’হাজার কোটিই এসেছিল রাজ্যে মমতা সরকার গঠনের পরে। রিপোর্টের তথ্যে এ-ও পরিষ্কার, সারদার উল্কাসদৃশ বৃদ্ধির সূচনা ২০০৯-এ। সারদা-উত্থানের এই ‘কালক্রম’কে ইডি এবং সিবিআই এখন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তারা চাইছে ওই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সারদা-কাণ্ডকে ফেলতে, যাতে কেলেঙ্কারির নেপথ্যে থাকা ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ চেহারাটা আরও স্পষ্ট হয়।

এবং এখানেই তৃণমূলের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সারদার বাড়বাড়ন্তের একটা ‘সমানুপাতিক সম্পর্কের’ আঁচ পাচ্ছেন সিবিআই-ইডির একাংশ। কী রকম?

তথ্য বলছে, তিন দশকের বাম শাসনের ভিতে প্রথম ধস নামে ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে। এক বছর বাদে, ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে বাম ধরাশায়ী হয়ে পড়ে। ৪২টি আসনের ২৬টি যায় বিরোধী দখলে। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী হন। কার্যত তখনই বামফ্রন্টের বিদায়ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনও টের পেয়ে যায়, তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে চলেছে। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে পালাবদল ঘটিয়ে তৃণমূলনেত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন।

ইডি-সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা বলছেন, ২০০৮-’০৯ সালে তৃণমূলের প্রতিপত্তি যখন বাড়তে শুরু করে, তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে সারদার কারবারও। ঘটনাটিকে নিছক সমাপতন হিসেবে না-দেখার যথেষ্ট কারণ মজুত রয়েছে বলে তাঁদের দাবি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ তৃণমূল-সারদা আঁতাঁতের দিকে ইঙ্গিত করছে, যা আরও জোরদার হয়েছে এসএফআইও-র রিপোর্টে। “আমাদের ধারণা, তৃণমূলের ক্ষমতালাভের পিছনে যেমন সারদার ভূমিকা রয়েছে, তেমন সারদার কারবারে বেনজির বৃদ্ধির পিছনেও তৃণমূলের আশীর্বাদ ছিল।” মন্তব্য কেন্দ্রীয় এক তদন্তকারীর। অন্য দিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূল নেতারা বারবার দাবি করেছেন, বামফ্রন্টের আমলেই সারদার জন্ম, এবং বামের হাত ধরেই ধীরে ধীরে তারা বেড়ে উঠেছে। বামফ্রন্ট সরকার সব জেনে-শুনে হাত গুটিয়ে ছিল বলে তাঁদের অভিযোগ। সারদার অবৈধ কাজকর্ম সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নজরদারি এজেন্সিগুলি কেন চুপ করে ছিল, সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে।

পাল্টা হিসেবে তৃণমূলের উত্থানের সঙ্গে সারদার আমানত-অভিযানের অস্বাভাবিক দুরন্ত গতিলাভের প্রসঙ্গই তুলে আনছেন বিরোধীরা। রাজ্যের এক সিপিএম নেতার মন্তব্য, “২০০৯-এর ২২ মে মমতা রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন।

দেখা যাবে, তার পরেই সারদার রমরমার সূচনা।” তাঁর মতে, ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম ভোট ব্যাঙ্কে যে ধস নেমেছিল, সারদা গোষ্ঠী ও তৃণমূল দু’পক্ষই তার ফায়দা লুটেছে। বিষয়টি আরও প্রাঞ্জল করে দিয়ে সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বৃহস্পতিবার বলেন, “তৃণমূলের তরফে সারদাকে একটা বার্তা দেওয়া হয়েছিল আমরা থাকলে তোমাদের রমরমা হবে।” সুজনবাবুর কথার সূত্র ধরে বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদারের বক্তব্য, “২০০৯-এ মদন মিত্র সারদা সংস্থার প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘বিন্দু বিন্দু থেকে সিন্ধু।’ এতেই বোঝা যায়, সারদার উত্থানে তৃণমূলের কী ভূমিকা।”

ওঁদের দাবি, সেই সাহায্য সারদা শেষ দিন পর্যন্ত পেয়েছিল। সে কারণেই সারদা-কাণ্ডে সিবিআই ঠেকাতে শাসক দল মাঠে নেমে পড়েছিল বলে ওঁদের অভিযোগ। সারদায় সিবিআই তদন্ত চেয়ে দায়ের করা মামলার প্রধান কাণ্ডারী যিনি, সেই কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের পর্যবেক্ষণ, “এসএফআইও-রিপোর্টেও পুরো ছবিটা আসেনি। সারদা বাজার থেকে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা তুলেছে।” তিনি মনে করেন, ঠিকঠাক তদন্ত হলে সব প্রকাশ পেয়ে যাবে। “আমি কোর্টেও বলেছি, সুদীপ্তের সঙ্গে তৃণমূলের বোঝাপড়া ছিল। এখনও বলছি। সিবিআই যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্ত করছে, তার জট যত খুলবে, তত ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।” এ দিন বলেছেন মান্নান।

এসএফআইও-রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা রজত মজুমদারের মতো প্রভাবশালীদের চাকরি দিয়ে কিংবা সংস্থার অনুষ্ঠানমঞ্চে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বা কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের মতো প্রভাবশালীদের দাঁড় করিয়ে সারদা গোষ্ঠী আমজনতার কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা তুলে ধরতে চেয়েছে। বিরোধীরাও এই জায়গায় চেপে ধরছে তৃণমূলকে। বুধ ও বৃহস্পতিবার সারদা-কাণ্ড নিয়ে সংসদে তৃণমূলকে তুলোধোনা করতে গিয়ে তৃণমূলের ‘সারদা-সংশ্রবের’ দিকে বারবার আঙুল তুলেছে বিজেপি। রাজ্যের এক বিজেপি নেতার কথায়, “সুদীপ্ত সেন তাঁর বিভিন্ন সংবাদপত্র ও চ্যানেলে লাগাতার এমন ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে প্রচার চালিয়েছেন, তাতে রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর সম্পর্কটা বেআব্রু হয়ে গিয়েছে।”

প্রায় একই সুর তদন্তকারীদের মুখে। সারদা-কাণ্ডে ধৃত তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষ জেল থেকে যে চিঠিটি লিখেছেন, তার উল্লেখ করে এ দিন সিবিআইয়ের এক অফিসার বলেন, “উত্তরবঙ্গের ডেলোর বৈঠকেও সুদীপ্ত সেন তৃণমূলনেত্রীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁর সব সংবাদপত্র ও চ্যানেলের মাধ্যমে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী করার চেষ্টা চালাবেন। উল্টো দিকে মুখ্যমন্ত্রীও সারদার সংবাদপত্র ও চ্যানেলকে কার্যত দলীয় মুখপত্র হিসেবে উল্লেখ করতেন।” প্রসঙ্গত, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে যাতে ওই সংবাদপত্রগুলি ছাড়া অন্য সংবাদপত্র রাখা না হয়, সে জন্য এক বার নির্দেশও জারি করেছিল মমতা সরকার।

প্রভাবশালীদের মারফত সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করাটা যে সারদার আমানত সংগ্রহের অন্যতম হাতিয়ার ছিল, অর্থনীতির শিক্ষকদের একাংশের কথাতেও তার ইঙ্গিত। তাঁদের বক্তব্য: এটা ঠিক যে, অস্বাভাবিক সুদের লোভে বহু আমানতকারী সারদায় টাকা রেখেছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সারদার প্রতি তাঁদের গভীর বিশ্বাসও কাজ করেছে। “সারদার বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেছিলেন, যে ধরনের রাজনৈতিক নেতারা এই ব্যবসার পিছনে রয়েছেন, তাতে টাকা কখনওই মার যাবে না। বিশ্বাসটা ওঁদের মনে সযত্নে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।” অভিমত এক শিক্ষকের। এ প্রসঙ্গে মহাকরণের সামনে মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়ে সারদার অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা চালু করে তার ছবি প্রচার কিংবা জঙ্গলমহলে রাজ্য-সারদা যৌথ উদ্যোগে স্বাস্থ্য-পরিষেবা কর্মসূচির উল্লেখ করেছেন অনেকে।

অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলেন, “ডাকঘর বা অন্য জায়গার সঞ্চয় ভেঙে লোকে সারদায় টাকা ঢুকিয়েছিলেন। তাই মাত্র ক’বছরেই সারদার এমন আস্বাভাবিক বৃদ্ধি।”

সিবিআইয়ের এক তদন্তকারী জানিয়েছেন, “এসএফআইও-র রিপোর্টে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর ব্যবসাবৃদ্ধির উল্লেখ রয়েছে, সেই অংশটি চিহ্নিত করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। “সারদার সাহায্যকারী হিসেবে যে সব প্রভাবশালীদের নাম উঠে এসেছে, তাঁদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রতারণার ষড়যন্ত্রের শিকড়ে পৌঁছনোর চেষ্টা চলছে।” বলেছেন তিনি।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC saradha scam CBI SFIO
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE