Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
হাওড়া হোটেল-কাণ্ড

পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই ধরা দিল দীপক

গত তেইশ দিন ধরে পুলিশ তার টিকি ছুঁতে পারেনি। বুধবার কার্যত পুলিশের চোখের সামনে দিয়েই গাড়ি করে আদালতে এসে আত্মসমর্পণ করল হাওড়া হোটেল-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত দীপক সাউ। দু’দিন আগেই হাওড়া আদালত তার আগাম জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল। এ দিন আদালত দীপককে ১৪ দিনের জন্য বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

হাওড়া আদালতে দীপক সাউ। বুধবার।  —নিজস্ব চিত্র।

হাওড়া আদালতে দীপক সাউ। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৪
Share: Save:

গত তেইশ দিন ধরে পুলিশ তার টিকি ছুঁতে পারেনি। বুধবার কার্যত পুলিশের চোখের সামনে দিয়েই গাড়ি করে আদালতে এসে আত্মসমর্পণ করল হাওড়া হোটেল-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত দীপক সাউ। দু’দিন আগেই হাওড়া আদালত তার আগাম জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল। এ দিন আদালত দীপককে ১৪ দিনের জন্য বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

পুলিশ ও আদালত সূত্রের খবর, এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ নিজের আইনজীবীর গাড়িতে চেপে আদালতে পৌঁছয় দীপক। গ্রেফতারি এড়াতে প্রায় আদালতের মূল প্রবেশদ্বারের সামনে গাড়ি রাখা হয়েছিল। গালে হাল্কা কাঁচাপাকা দাড়ি, আকাশি রঙের জামা-কালো প্যান্ট পরা দীপক গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে আদালতে ঢুকে যায়। আদালত চত্বর তখন সাদা পোশাকের পুলিশে ঠাসা। কিন্তু কেউই তাকে ধরতে পারেননি। আদালতে ঢুকে আত্মসমর্পণ করার পরে কোর্ট লক-আপে নিয়ে যাওয়ার জন্য দীপককে বাইরে বার করে পুলিশ। তখনই সে সাংবাদিকদের বলে, “ওই হোটেলে অশালীন কাজকর্ম শুরু হয়েছিল। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম বলেই এ ভাবে ফাঁসানো হল।”

গত ২০ জুন হাওড়ার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি দীপক সাউয়ের বিরুদ্ধে হাওড়া ব্রিজ লজের ম্যানেজার আশিস মান্নাকে মারধর করে মোবাইল কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই রাতেই গোলাবাড়ি থানায় দীপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন আশিসবাবু। এর এক দিন পরে অর্থাৎ ২২ জুন বিকেলে হোটেলমালিক সুমিত নাহাকে অপমান করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে হোটেল থেকে বার করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে দীপকের বিরুদ্ধে। তবে ওই ঘটনার পরে সুমিতবাবু পুলিশকে কিছু জানাননি। ওই রাতেই দীপক এবং তার আর এক বন্ধু রিয়াজ আহমেদ ফোন করে সুমিতকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিল বলে অভিযোগ। তার জেরেই সুমিতবাবু হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন তাঁর মা মঞ্জু নাহা। এ দিন মঞ্জুদেবী বলেন, “মনে হচ্ছে এত দিন হাওড়াতেই কোনও নেতার ছত্রচ্ছায়ায় লুকিয়ে ছিল দীপক। তবে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করায় স্বস্তি পেয়েছি। ওর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”

২৩ জুন সুমিত নাহার মৃত্যুর খবর ছড়ানোর পরেই দীপক নিখোঁজ হয়ে যায়। তার স্ত্রী গীতাদেবী জানিয়েছিলেন, ওই দিন দুপুরে মেয়েকে স্কুল থেকে আনার পরে একটু আসছি বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল দীপক। আর সে বাড়ি ফেরেনি। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছিল, মাছের ব্যবসার পরিচিতির সুবাদে অন্ধ্র, উত্তরপ্রদেশে গিয়ে লুকিয়ে রয়েছে সে। ওই ঘটনার আর এক অভিযুক্ত রিয়াজ আহমেদকে গত ২৯ জুনই গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। সে এখন জেল হেফাজতে।

তবে ঘটনার পর থেকে দীপকের পরিবারের লোকেদের উপরে স্থানীয় নেতারা চাপ দিচ্ছিলেন আত্মসমর্পণের জন্য। গীতাদেবীও জানিয়ে ছিলেন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল সভাপতি সন্তোষ সাহানিও জেলা স্তরের নেতাদের নির্দেশ মতো তাঁদের বাড়িতে এসে দীপককে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু এ দিন দীপকের আত্মসমর্পণ কি সেই চাপেই?

জেলার নেতাদের একাংশ কার্যত তা স্বীকার না করলেও তাঁদের কথায়, “দীপকের আর কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। তার জন্য সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।” স্থানীয় সূত্রের খবর, রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী তথা তৃণমূলের হাওড়া জেলা সভাপতি (শহর) অরূপ রায়ের ঘনিষ্ঠ উত্তর হাওড়ার তৃণমূল সভাপতি তথা মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরীর এক সময়ের ‘ডান হাত’ ছিল দীপক সাউ। এলাকায় মিটিং, মিছিল-সহ বিভিন্ন দলীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন সে-ই করত। এমনকী দীপকের মোটরবাইকে চেপে গৌতমবাবুকে ঘুরতেও দেখা যেত। কিন্তু এলাকায় দীপকের ‘দাদাগিরি’ বাড়তে থাকায় ২০১০ সালে তাকে ওয়ার্ড সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই জায়গায় আনা হয় সন্তোষ সাহানিকে। যাঁর স্ত্রী বর্তমানে ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর।

হোটেল-কাণ্ডের আগে পর্যন্ত গৌতমবাবুর সহযোগী হয়ে দীপক কাজ করেছেন বলেই দাবি স্থানীয় বাসিন্দা এবং তার পরিবারের। তাঁদের দাবি, সুমিত নাহার মৃত্যুর পরে দলীয় নেতারা দীপককে আর সাহায্য করতে চাননি। সে জন্যই অন্য রাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় সে। কিন্তু নিজেদের ভাবমূর্তি বজায় রাখতেই দলীয় নেতারা দীপককে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন বলেও জানান অভিযুক্তের বন্ধুরা। অরূপবাবুর দাবি, “পুলিশকে বারবার বলা হয় দীপককে গ্রেফতার করতে হবে। কিন্তু মোবাইলের সিম কার্ড ফেলে দেওয়ায় ওর সন্ধান পাচ্ছিল না। ২০১০ সালে এ রকম তোলাবাজির অভিযোগ পাওয়ার পরেই ওকে পদ থেকে সরিয়ে দেয় দল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE