Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পাড়ুই কাণ্ডে পলিগ্রাফে নারাজ দুই পুলিশই

যাঁদের বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য পলিগ্রাফ পরীক্ষার ব্যবস্থা, আপত্তি তুলেছেন তাঁরাই। তাই পাড়ুই হত্যাকাণ্ডের দুই প্রাক্তন তদন্তকারী অফিসার সম্পদ মুখোপাধ্যায় ও দ্বিজরাজ সাহানার পলিগ্রাফ পরীক্ষা আপাতত হচ্ছে না।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৮
Share: Save:

যাঁদের বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য পলিগ্রাফ পরীক্ষার ব্যবস্থা, আপত্তি তুলেছেন তাঁরাই। তাই পাড়ুই হত্যাকাণ্ডের দুই প্রাক্তন তদন্তকারী অফিসার সম্পদ মুখোপাধ্যায় ও দ্বিজরাজ সাহানার পলিগ্রাফ পরীক্ষা আপাতত হচ্ছে না। আপত্তির কারণ হিসেবে ওই দুই পুলিশ অফিসার বুধবার সিউড়ি আদালতে জানান, তাঁরা অসুস্থ। তাই তাঁরা পলিগ্রাফ পরীক্ষার সামনে বসতে চান না।

কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তৈরি রাজ্য পুলিশের ডিজি-র নেতৃত্বাধীন স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট) বা বিশেষ তদন্তকারী দল গত ৯ এপ্রিল সিউড়ি আদালতে ওই দুই অফিসারের পলিগ্রাফ পরীক্ষা করার অনুমতি চেয়েছিল। ১১ এপ্রিল সেই অনুমতি দেয় আদালত। কিন্তু যাঁদের পলিগ্রাফ পরীক্ষা হওয়ার কথা, আইন অনুযায়ী তাঁদের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। দুই পুলিশ অফিসার সেই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে রাজি কি না, তা জানানোর জন্য আদালত এ দিন তাঁদের ডেকেছিল। দুই অফিসারই বেঁকে বসায় আপাতত তাঁদের পলিগ্রাফ পরীক্ষা হচ্ছে না। এ দিন সিউড়ি আদালতে দুই অফিসারই জানান, তাঁরা অসুস্থ। বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী পাড়ুই থানার তৎকালীন ওসি সম্পদবাবুর কাছে জানতে চান, তাঁর উপরে কোনও রকম চাপ আছে কি না। ওই পুলিশ অফিসার অবশ্য কোনও চাপের কথা মানতে চাননি।

হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ গত ১১ এপ্রিল পাড়ুই মামলার শুনানি তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দেওয়ায় মামলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন নিহত সাগর ঘোষের ছেলে হৃদয় ঘোষ। এ দিন পলিগ্রাফ পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে যাওয়ায় হৃদয়বাবুর প্রতিক্রিয়া, “অসুস্থতা কীসের! ওঁরা তো প্রত্যেকেই দিব্যি কাজ করছেন। ওঁরা যে জোর করে আমার পরিবারকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিলেন, পলিগ্রাফ পরীক্ষায় সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে বুঝতে পেরেই ওঁরা তাতে সম্মতি দেননি।” এর ফলে তাঁদের সুবিচার পাওয়ার আশা আরও ক্ষীণ হয়ে গেল বলে হৃদয়বাবুর আশঙ্কা।

বছর পঞ্চাশের সম্পদ মুখোপাধ্যায় এখন জেলা গোয়েন্দা বিভাগে (ডিআইবি) কর্মরত। তবে ৫৮ বছরের দ্বিজরাজ সাহানা এখনও পাড়ুই থানাতেই আছেন। এ দিন বেলা ১১টা ৪০ মিনিট নাগাদ এজলাসে ডাক পড়ে সম্পদবাবুর। বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী তাঁকে প্রশ্ন করেন, আপনি অসুস্থ বলে জানিয়েছেন। তার মানে কি আপনি পলিগ্রাফ টেস্টে রাজি নন? সম্পদবাবু উত্তর দেন, “আমার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়েছে। তা ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও সুগারের সমস্যায় ভুগছি।” বিচারক ফের জানতে চান, তা হলে শারীরিক অসুস্থতা না-থাকলে এই টেস্টে আপনার আপত্তি ছিল না, তা-ই তো? মাথা নাড়েন সম্পদবাবু। এর পরে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিজরাজবাবুও অসুস্থতার জন্য পলিগ্রাফ টেস্টের ব্যাপারে তাঁর আপত্তির কথা জানান। তিনি বলেন, “আমারও হার্টের সমস্যা রয়েছে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমেছে।”

বিচারক বলেন, আপনাদের সম্মতি না-থাকলে আমি সেই অনুযায়ী নির্দেশ দেব। দুই পুলিশ অফিসারই জানান, পলিগ্রাফ ছাড়া তাঁরা তদন্তে সিটকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন। বিচারক হঠাৎ সম্পদবাবুর কাছে জানাতে চান, শুধু শারীরিক অসুস্থতার জন্যই পলিগ্রাফে আপত্তি, নাকি এই টেস্ট থেকে সরে যাওয়ার জন্য কোনও চাপ রয়েছে? সম্পদবাবু জানান, কোনও চাপ নেই। অসুস্থতাই কারণ। বিচারক তার পরেই সিটের সদস্য সিঞ্চন রায়চৌধুরীর কাছে জানতে চান, ওঁরা পলিগ্রাফ পরীক্ষায় সম্মত নন। এর পরে আপনাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? সিঞ্চনবাবু জানান, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার পরেই তা বলতে পারবেন।

আদালত থেকে বেরিয়েও নিজেদের অসুস্থতার কথাই বলেন সম্পদবাবুরা। দ্বিজরাজবাবু বলেন, “কিছু দিন আগেই ভিন্ রাজ্য থেকে চিকিৎসা করিয়ে ফিরেছি। আমি এখনও অসুস্থ।” আর সম্পদবাবু বলছেন, “হার্টে অস্ত্রোপচার হয়েছে। সুগার, কিডনিরও সমস্যা আছে। পলিগ্রাফের ধকল নিতে পারব না।”

ওই দুই পুলিশ অফিসারের পলিগ্রাফ পরীক্ষা জরুরি ছিল কেন?

গত বছর ২১ জুলাই বীরভূমের পাড়ুই থানা এলাকার কসবা-নবগ্রামে খুন হন পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ। ওই সময় পাড়ুই থানার ওসি ছিলেন সম্পদবাবু। আর দ্বিজদাসবাবু ছিলেন ওই খুনের মামলার তদন্তকারী অফিসার। নিহত সাগরবাবুর স্ত্রী ও পুত্রবধূর অভিযোগ ছিল, পাড়ুই থানার ওই দুই অফিসার জোর করে তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছেন। ওই কাগজে কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে পুলিশ নিজেই এফআইআর দায়ের করেছিল। পুলিশ অবশ্য বরাবরই ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল। ওই পুলিশ অফিসারেরা সত্য কথা বলছেন কি না, তা জানতেই পলিগ্রাফ পরীক্ষা জরুরি বলে সিটের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন জানানো হয়েছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই সিউড়ি আদালতের বিচারক এ দিন ওই দুই অফিসারের কাছে জানতে চান, পলিগ্রাফ পরীক্ষায় তাঁদের সম্মতি আছে কি না। সরকারি আইনজীবী কুন্তল চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে এ দিন ওই দুই অফিসার পলিগ্রাফ টেস্টে নিজেদের অসম্মতির কথা আদালতে জানান। আদালত তা মেনে নিয়েছে।”

নিহতের ছেলে সুপ্রিম কোর্টে

কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পাড়ুই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোমবার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করছেন নিহত সাগর ঘোষের ছেলে হৃদয় ঘোষ। বুধবার তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছি। সেখানেই সুবিচার পাব বলে আশা করছি।” ১১ এপ্রিল পাড়ুই মামলার শুনানি তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দেয় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ। তারা জানায়, তিন সপ্তাহ পরে ওই বেঞ্চেই শুনানি হবে। বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে নয়। তার পরেই হৃদয়বাবু সিদ্ধান্ত নেন, ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাঁরা সর্বোচ্চ আদালতে যাবেন। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের সার্টিফায়েড কপি বা প্রত্যয়িত প্রতিলিপি এ দিনই হৃদয়বাবুর আইনজীবীদের হাতে পৌঁছেছে। হৃদয়বাবুর কৌঁসুলি শীর্ষেন্দু সিংহরায় জানান, আজ, বৃহস্পতিবার ওই প্রতিলিপি নিয়ে তাঁরা কলকাতার এক প্রবীণ আইনজীবীর বাড়িতে যাবেন। সুপ্রিম কোর্টে মামলা করার সব কাগজপত্র তৈরি করে দিতে রাজি হয়েছেন তিনি। কলকাতার কয়েক জন আইনজীবী নিজেদের খরচে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করতে রাজি হয়েছেন বলেও জানান শীর্ষেন্দুবাবু। তবে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কোনও আইনজীবী এই মামলায় যোগ দিচ্ছেন না। হৃদয়বাবুও তা চাইছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dayal sengupta siuri parui incident polygraph
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE