Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পেঁয়াজি চেয়ে হন্যে সন্ধের আড্ডা

গান বাজছে ঝরঝরে ট্রানজিস্টারে, রোজ যেমন বাজে মোড়ের চপের দোকানটায়। পাশে চলছে আড্ডাও। কিন্তু সেই ম-ম করা গন্ধটা নেই। আড্ডাধারীদের মেজাজও তেমন তন্দুরস্ত নয়। হবে না-ই বা কেন? পেঁয়াজ নিয়েই পেঁয়াজি! কেজিতে দর ৭০ ছাড়িয়ে ৮০ টাকার দিকে চড়ছে। তাই পেঁয়াজিও হাতছাড়া। ব্যারাকপুর-কল্যাণী শিল্পাঞ্চলের তেলেভাজার দোকানগুলিতে এক লাফে বেড়ে গিয়েছে পেঁয়াজির দাম।

কবে ফিরবে এই চেনা ছবি? ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

কবে ফিরবে এই চেনা ছবি? ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:৩৩
Share: Save:

গান বাজছে ঝরঝরে ট্রানজিস্টারে, রোজ যেমন বাজে মোড়ের চপের দোকানটায়।
পাশে চলছে আড্ডাও। কিন্তু সেই ম-ম করা গন্ধটা নেই। আড্ডাধারীদের মেজাজও তেমন তন্দুরস্ত নয়।
হবে না-ই বা কেন?
পেঁয়াজ নিয়েই পেঁয়াজি! কেজিতে দর ৭০ ছাড়িয়ে ৮০ টাকার দিকে চড়ছে। তাই পেঁয়াজিও হাতছাড়া।
ব্যারাকপুর-কল্যাণী শিল্পাঞ্চলের তেলেভাজার দোকানগুলিতে এক লাফে বেড়ে গিয়েছে পেঁয়াজির দাম। পলতা, জগদ্দল, নৈহাটির বড় তেলেভাজার দোকানগুলিতে এত দিন ১০ টাকায় পাঁচটি পেঁয়াজি মিলত। এখন মিলছে দু’টো। খদ্দেরদের যাতে হার্টফেল না হয়, তার জন্য বেসন গোলার সাইজ একটু বাড়ানো হয়েছে। ছোট দোকানগুলোয় ফুলুরি, পকোড়া বা আর সব চপ পাওয়া গেলেও পেঁয়াজের গন্ধটুকুও নেই।
কোচবিহার স্টেশন মোড় এলাকার তেলেভাজা বিক্রেতা বুদ্ধেশ্বর বর্মনও কবুল করেন, “পাঁচ টাকায় সাতটা পেঁয়াজি বিক্রি করতাম। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন পাঁচটার বেশি দিতে পারছি না। ফলে খদ্দেররা অনেকেই রাগারাগি করছেন। কিন্তু আমি কী করব!” নতুনপল্লির মহম্মদ বুলুর কথায়, “এক মাসে পেঁয়াজের দাম ৩০ টাকা থেকে ৮০ টাকায় চড়েছে। অথচ চপ, চাউমিন, ওমলেটে পেঁয়াজ কম দিলে ক্রেতারা নিতে চাইছেন না। আবার বেশি দাম চাইলে অনেকে আপত্তি করছেন।”
বহরমপুরেও বিভিন্ন তেলেভাজার দোকান থেকে পেঁয়াজি উধাও। খদ্দের ধরে রাখতে কেউ-কেউ যদিও বা পেঁয়াজি ভাজছেন, তা এতই ছোট যে, এক কামড়ে মুখে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোনও কোনও দোকান পেঁয়াজের সঙ্গে কুচি করে আলু মিশিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে। এক তেলেভাজা মালিকের টিপ্পনী, ‘‘পিঁয়াজের যা ঝাঁজ তাতে মুখ পুড়ে যেতে পারে, তাই অল্প পিঁয়াজের সঙ্গে আলু কুচিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছি!’’

গোরাবাজার রেজাউল করিম মার্কেট কমপ্লেক্সের কাছে ২৭ বছর ধরে তেলেভাজা ভেজে আসছেন লক্ষ্মণ হালদার। জানালেন, এমনিতে রোজ সন্ধেয় ৬-৭ কিলো পেঁয়াজের পেঁয়াজি হত। এখন দিনে দু’কিলোর বেশি পেঁয়াজ কিনতে পারছেন না। তা ছাড়া, বেশি দামে পেঁয়াজ কিনে পেঁয়াজি ভেজে লাভও থাকছে না। পঞ্চাননতলা মোড়ের কাছে দোকান উদয় মণ্ডলের। তিনি বলেন, ‘‘কয়েক দিন হল, পেঁয়াজি ভাজা বন্ধ রেখেছি। তার বদলে বেশি করে ফুলুরি আর ডালবড়া ভাজছি।’’ মোহনের মোড়ে বহু বছর ধরে তেলেভাজার দোকান চালিয়ে আসছেন বিশ্বনাথ মার্জিত। এর আগে শেষ কবে পেঁয়াজি ভাজা বন্ধ রেখেছেন, তা বহু ভেবেও মনে করতে পারলেন না।

ব্যারাকপুর স্টেশনের কাছে অমিত সাহা রোজ অন্তত দু’ঝুড়ি পেঁয়াজি বানাতেন। গত সোমবার থেকে পেঁয়াজি ভাজা বন্ধ শুধু দাম বাড়ার কারণে। অমিত বলেন, ‘‘পেঁয়াজের এখন যা দাম, পেঁয়াজি করলে এক-একটা অন্তত পাঁচ টাকায় বিক্রি করতে হবে। তাতে আমার বা ক্রেতার কারও লাভ হবে না। যদি বিক্রি না হয়, তা হলে তো আমার লোকসান।’’

ফলে পোয়াবারো হয়েছে নিরামিষ চপ বিক্রেতাদের। যেমন রঘুনাথগঞ্জের ষষ্ঠিতলা বাজারের তমাল দাস গত পঁচিশ বছর ধরে আদা ও অন্য মশলা দিয়ে তেলেভাজা বানিয়ে আসছেন। পেঁয়াজ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। তিনি বরং বেগুন বা সরষের তেলের দাম বাড়ায়।

কিন্তু রোজ সন্ধেয় যাঁদের পেঁয়াজি না হলে মন হু-হু করে, তাঁরা করবেন কী? পকোড়া বা ফুলুরিতে কি তাঁদের মন ওঠে? শ্যামনগর স্টেশনের চার নম্বর প্লাটফর্মে রোজ সন্ধেয় আড্ডা দেন প্রবীণ অমল পাল, সঞ্জয় রায়, প্রণব বিশ্বাসেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? পেঁয়াজির কোনও তুলনা নেই। আর এই বর্ষাই তো হল পেঁয়াজি-মুড়ির আসল সময়।’’ কোচবিহারের সম্রাট কুণ্ডুর আক্ষেপ, “সন্ধের আড্ডায় রোজ অন্তত ৫০ টাকার পেঁয়াজি আসত। দাম বেড়ে যাওয়ায় তা একটু কমিয়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু পেঁয়াজি যা মিলছে তাতে বেসনের ভাগ বেশি। সেই স্বাদটা পাচ্ছি না।” সকলেই অবশ্য পরিস্থিতির চাপে হার মানতে রাজি নন। যেমন কল্যাণী স্টেশনের কাছে ‘খাই খাই সংঘ’-এর সদস্যেরা। ক্লাবের পাশেই একগুচ্ছ তেলেভাজার দোকান। কিন্তু পেঁয়াজি ভোজবাজির মতো ভ্যানিশ। তার বদলে বেগুনি, লটে, চিংড়ি, মোচা, সয়াবিনের চপ বিকোচ্ছে। ক্লাবের সদস্যেরা অবশ্য তাতে হার মানতে রাজি নন। চাঁদা তুলে পালা করে বাড়ি থেকেই পেঁয়াজি ভেজে আড্ডায় নিয়ে আসছেন তাঁরা।

পেঁয়াজের দাম বাড়লেও বাজারে পেঁয়াজ নেই তা কিন্তু নয়। বছরের গোড়ায় পেঁয়াজ ওঠার পরে মাঠেই পাইকারি আট-দশ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করেছিলেন চাষিরা। কিছু আড়তদার এখন তা ছাড়ছেন ষাট-পঁয়ষট্টি টাকা দরে। যা বাজারে বিক্রি হচ্ছে সত্তর থেকে আশি টাকায়। পেঁয়াজি-প্রেমী অনেকেরই দাবি, বিষয়টিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ করা উচিত। প্রণববাবুরা বলেন, ‘‘দরকার হলে মহকুমাশাসকের কাছেও আমরা আর্জি জানাতে পারি।’’ বহরমপুরের নতুন বাজারের আড়তদার অমর ভকত অবশ্য দাবি করেন, পেঁয়াজের আমদানি কম হওয়াতেই এই সঙ্কট। ভিন্‌ রাজ্য লরি যেমন কম আসছে, বর্ষায় অনেক পেঁয়াজ পচেও গিয়েছে।

কারণ যা-ই হোক। আপাতত সন্ধের আড্ডায় ভাঙা ট্রানজিস্টারে একটাই গান— ‘চোখে নামে বৃষ্টি, বুকে ওঠে ঝড় যে/ তুমি তো আমারই ছিলে, আজ কত পর যে...।’

পাড়ার আড্ডা পেরিয়ে ফেসবুকেও গুনগুন করছে সেই আকুতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE