Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বকেয়া নিয়ে অশান্তি, পিটিয়ে খুন মালিককে

রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে শনিবার আরও একটা ‘রক্তাক্ত দিন’ হিসেবে চিহ্নিত হল। বকেয়া সংক্রান্ত অসন্তোষের জেরে বাগান চত্বরেই খুন হয়ে গেলেন সোনালি চা বাগানের মালিক রাজেশ ঝুনঝুনওয়ালা (৪৩)। এ দিন দুপুর থেকেই প্রাপ্য বকেয়া নিতে মালবাজারের সোনালি চা-বাগানের অফিসের সামনে লাইন দিয়েছিলেন প্রায় শ’খানেক শ্রমিক। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আচমকা ঘোষণা করা হয়, ব্যাঙ্কে কিছু সমস্যা হওয়ায় টাকা আসেনি। পরে বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হবে।

কিশোর সাহা
বাগরাকোট শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১১
Share: Save:

রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে শনিবার আরও একটা ‘রক্তাক্ত দিন’ হিসেবে চিহ্নিত হল।

বকেয়া সংক্রান্ত অসন্তোষের জেরে বাগান চত্বরেই খুন হয়ে গেলেন সোনালি চা বাগানের মালিক রাজেশ ঝুনঝুনওয়ালা (৪৩)।

এ দিন দুপুর থেকেই প্রাপ্য বকেয়া নিতে মালবাজারের সোনালি চা-বাগানের অফিসের সামনে লাইন দিয়েছিলেন প্রায় শ’খানেক শ্রমিক। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আচমকা ঘোষণা করা হয়, ব্যাঙ্কে কিছু সমস্যা হওয়ায় টাকা আসেনি। পরে বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হবে।

বাগানের কয়েক জন পদস্থ কর্তা অফিস থেকে বেরিয়ে এই ঘোষণা করা মাত্রই তপ্ত হয়ে ওঠেন শ্রমিকরা। ঘোষণা শেষ হওয়ার আগেই হুড়মুড়িয়ে লাইন ভেঙে শ্রমিকরা তেড়ে যান বাগান কর্তাদের দিকে। রাজেশের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ঝোপের আড়ালে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই পাথর, লাঠি, ভোজালি, খুকরি দিয়ে পিটিয়ে-কুপিয়ে খুন করা হয় তাঁকে। তার পরে বাগানের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে ফিরে যায় আততায়ীরা।

এ দিন বিকেলের ওই ঘটনা ফুট কয়েক দূরত্ব থেকে দেখেছেন বাগান-ম্যানেজার অঞ্জনকুমার মোদি। সন্ধ্যায় প্রায় কাঁপতে কাঁপতে অঞ্জনবাবু জানান, বকেয়ার ব্যাপারে ঘোষণা হতেই উত্তেজনা ছড়ায়। তখন রাজেশ বাইরে বেরিয়ে আসেন। অঞ্জনবাবু বলেন, “ঘোষণা শোনা মাত্র জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক লাইন থেকে দৌড়ে এসে বাগান-চিকিৎসক উত্তম রাজবংশীকে জাপটে ধরেন। তাঁর সঙ্গে বচসা শুরু হয়।” তার মধ্যেই রাজেশকে ধরে টানতে থাকেন শ্রমিকরা। এই সময়ে কয়েক জনকে পাথর ছুড়তেও দেখেন অঞ্জনবাবু। তাঁর কথায়, “ঝোপের আড়ালে রাজেশবাবুকে ফেলে শুরু হয় মারধর। বড়জোর মিনিট পনেরো। চোখের সামনেই দেখলাম, রক্তাক্ত রাজেশবাবুর দেহ উপুড় হয়ে পড়ে থাকল!”

খবর পেয়ে জলপাইগুড়ি থেকে মালবাজার রওনা হন পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল। বাগান থেকে রাজেশের রক্তাক্ত দেহ পুলিশই তুলে আনে। কুণাল বলেন, “রাতেই বেশ কয়েক জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেন এ ভাবে বাগান মালিককে খুন হতে হল, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”

নিছকই বকেয়া সংক্রান্ত অসন্তোষের জেরে এই খুন, নাকি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে?

এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ বিশেষ মুখ না খুললেও কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজেশ ঝুনঝুনওয়ালা ওরফে রাজেশ অগ্রবালের পরিচয় এবং বিবিধ কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে একাধিক বিতর্ক।

২০০৮-এর ডিসেম্বরে বেনিয়াপুকুর থানায় এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, ‘দুঃসময়ে’ পড়া চা বাগানের মালিক পরিচয় দিয়ে তাঁর কাছে চাকরি নিয়েছিলেন রাজেশ। ওই ব্যবসায়ীর ‘মিনারেল ওয়াটার’ সংস্থায় চাকরি পাওয়ার পরেই তাঁর নাম জড়ায় তহবিল তছরুপের ঘটনায়। পরে, গাড়ি কেনার সময়েও চেক ‘বাউন্স’ করায় রাজেশের বিরুদ্ধে কলকাতার গোয়েন্দা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের হয়। এ ছাড়া, গ্যাংটকে একটি সরকারি অ্যামিউজমেন্ট পার্ক চালানোর দায়িত্ব নিয়ে সিকিম সরকারকে রাজেশ যে ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকার চেক দিয়েছিলেন, সেটিও ‘বাউন্স’ করেছিল বলে অভিযোগ। তালিকায় রয়েছে, কলকাতার একটি সোনার দোকানে প্রতারণার অভিযোগও।

পুলিশের দাবি, সব মিলিয়ে রাজেশের বিরুদ্ধে অন্তত ৩০ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ ছিল। ২০১০ সালের অগস্টে শ্রমিক সেজে পালাতে গিয়ে সিকিম-পশ্চিমবঙ্গ সীমানায় রংপোর কাছে গ্রেফতার হন তিনি। পরে জামিন পান। নিহতের পরিবার অবশ্য কোনও অভিযোগই মানতে চায়নি।

আদতে কলকাতার নিউ আলিপুরের বাসিন্দা রাজেশ ঝুনঝুনওয়ালার ‘কাজকর্ম’ নিয়ে যে নানা বিতর্ক রয়েছে, নবান্ন সূত্রেও তার ইঙ্গিত মিলেছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব বলছেন, “আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে। তবে দেখতে হবে, ঘটনার পিছনে কোনও অন্য উস্কানি রয়েছে কি না।” শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, “শ্রমিকদের কোনও ব্যাপারে আপত্তি-অসন্তোষ থাকতেই পারে। তা বলে খুনের ঘটনা কখনওই মেনে নেওয়া যায় না।” রাজেশের খুড়তুতো ভাই মালবাজারের বাসিন্দা অমিত অগ্রবাল বলেন, “এই খুনের পিছনে চক্রান্ত রয়েছে। কেবল মজুরি বাকি থাকায় এমন ঘটনা ঘটতে পারে না।”

নবান্নের এক পদস্থ কর্তা জানান, ওই বাগানের শ্রমিকদের প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ টাকা বকেয়া ছিল। শ্রমিকদের অন্য কোনও সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হতো না। এর আগেও মজুরির দাবিতে ওই বাগানে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে বলে সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে।

৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের বাগরাকোট মোড় থেকে সাত কিলোমিটার ভিতরে সোনালি চা বাগানটি রুগ্ণ বলেই পরিচিত। ১৯৭০ সাল থেকে বাগানটি রাজেশবাবুদের পরিবারের মালিকানাধীন। রুগ্ণ হয়ে পড়ায় ২০০০ সালের পরে বাগান পরিচালনার ভার নেয় রাজ্য সরকারের চা-উন্নয়ন পর্ষদ। হাইকোর্টে মামলা জিতে বছর কয়েক আগে বাগানের দায়িত্ব নেন রাজেশ। তবে ডুয়ার্সের অধিকাংশ বাগানের পাওনা মেটানোর সঙ্গে সোনালি চা বাগানের ‘পদ্ধতি’তে কিছু অসংগতি ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। ২১৭ হেক্টরের বাগানটিতে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৭০, অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন অন্তত ২০০ জন। ওই সাড়ে শ্রমিকদের প্রায় দু’মাসের মজুরি এখনও বাকি বলে জানা গিয়েছে। পনেরো দিন অন্তর যে মজুরি দেওয়ার কথা, তা দিতে মাসখানেক সময় লেগে যাচ্ছিল বলেও জানা গিয়েছে। মিলছিল না পিএফ, গ্র্যাচুইটিও।

বকেয়া মেটানোর দাবিতে গত ক’দিন ধরেই দাবি জানাচ্ছিলেন শ্রমিকেরা। সমস্যা সমাধানের জন্য রাজেশ নিজেই কলকাতা থেকে এসে শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করে ছিলেন। সপ্তাহখানেক ধরে বাগানেই ছিলেন তিনি। এ দিনই শ্রমিকদের বকেয়া মেটানোর কথা ছিল। ‘ব্যাঙ্ক-সমস্যা’য় তা না মেটায় আশ্বাস দিয়েছিলেন, দু-এক দিনেই সবার বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হবে।

জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “তার আগেই বিতর্কিত ওই বাগান মালিকের সঙ্গে ‘হিসেব’ চুকিয়ে ফেললেন শ্রমিকেরা।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

murder case rajesh jhunjhunwala tea garden owner
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE