আকাশের কাছাকাছি শামুকখোলের ঘরবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।
ভোর থেকে কলকাকলি, খুনসুটি, মাঝে-মধ্যে ঈষৎ ঝগড়া-বিবাদও।
দেড়-দুশো ঘর পাখপাখালির বসতে একটু হট্টগোল তো হবেই। বর্ষার ডেমুরটিটায় যেন ফের প্রাণ ফিরেছে।
বীরভূমের খয়রাশোল ব্লকের গ্রামটা অবশ্য বছরভর এই সময়টার অপেক্ষাতেই বসে থাকে। গ্রামের শেখ ইজরাইল বলছেন, ‘‘ওরা না এলে বড় মরা মরা লাগে গ্রামটা।’’ জৈষ্ঠ্য মাস পড়লেই খর-গ্রীষ্মেও তাই পাখপাখালির ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকেন ওঁরা। গ্রামের মসজিদের পাশে কবেকার প্রাচীন বটগাছটায় শামুকখোলের ঝাঁক ডানা ঝাপটাতেই গ্রামের যেন উৎসব লেগে যায় তাই।
এ বারও ব্যতিক্রম হয়নি। কামারের হাপর টানার মতো এক টানা ঘ্যাসর-ঘ্যাঁস ডাকে সেই মে-জুনের দুপুর মুখর করে রেখেছে তারা। দিন আরও গড়ালে শ্রাবণেই কাট-কুটোর অবিন্যস্ত বাসা ভরে উঠেছে ছানাপোনায়। খানতিনেক শাবক নিয়ে মা শামুকখোলের শ্বাস নেওয়ার সময় নেই। মাঠে-বিলে পোকামাকড়, ছোট মাছ, ফড়িং-কেঁচো মায় শামুক ধরে এনে ছানাপোনাদের মুখে তুলে দিচ্ছে পরিশ্রমী বাবা। ছবিটা এখন চেনা হয়ে গিয়েছে ডেমুরটিটার।
গ্রামের ইন্দ্র বাউরি বলছেন, আগে ওরা ঘর বাঁধত শুধু ওই বট গাছে, কয়েক বছর ধরে পাশের তেঁতুল আর আম গাছটাতেও মৌরুসি পাট্টা ওদের।’’ দু-হাত জড় করে প্রণাম করেন ইন্দ্র। গ্রামের বিশ্বাস শামুকখোলই গ্রামে বয়ে আনে আবাদের সুদিন, সমৃদ্ধি।
গ্রামবাসীদের তাই যত্নআত্তিরও শেষ নেই। বাসা থেকে ছানারা পড়ে গেলে গাছে তুলে দেওয়া থেকে ভিন গাঁয়ের কেউ এসে যাতে তাদের বিরক্ত করতে না পারে সে দিকেও কড়া নজর ডেমুরটিটার।
এ সবই অবশ্য হেমন্ত পর্যন্ত। পুজো শেষে, বাতাসে হিমেল আভাস মিলতেই শামুকখোলের দল ধীরে ধীরে ডানা ঝাপটে ফিরে যায় মাঠের দিকে। গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, গত বিশ-পঁচিশ ধরে এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে ডেমুরটিটায়।
পাখি-বিশারদেরা জানাচ্ছেন, স্টর্ক প্রজাতির পাখিগুলির সাবেক নাম ওপেনবিল স্টর্ক। আকারে বড়সড়, অনেকটা সারসের মতো। সাদা-ধূসর পালকে ঠাসা গা। লেজের কাছে সামান্য কালো। দুই ঠোঁটের মাঝে সামান্য ফাঁক— পুরনো জুতোর শুকতলার মতো কড়া এবং শক্ত ঠোঁট। সে ঠোঁটে শামুক ধরার জন্যই তাদের এমনতরো নামকরণ। রাজ্য জুড়ে জলার ধারে শামুকখোল অবশ্য চোখে পড়ে বিভিন্ন জায়গায়। তবে ঘর বাঁধার সময়ে এরা সাধারনত জোটবদ্ধ ভাবে থাকে। বেছে নেয় বড়সড় কোনও ঝাঁকড়া গাছ।
ডেমুরটিটার বটগাছটি যেমন তাদের বেজায় প্রিয়। গ্রামের সোমনাথ বাউরি বলছেন, ‘‘শীতে ওরা ফিরে গেলে বটগাছটার দিকে তাকানো যায় না, কেমন মন খারাপ হয়ে যায়।’’ কাজী আখতার বলছেন, ‘‘পড়শি চলে গেলে মন খারাপ তো হবেই। শীত শেষে, আকাশে ঈদের চাঁদ খোঁজার মতো আমরা তাই ওদের খুঁজি। অপেক্ষায় থাকি, কবে আসবে শামুকখোলের দল!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy