সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে সিবিআই। এ বার ওই সাংসদের সংস্থার বন্দরে পণ্য খালাস নিয়েও তদন্তে নামল তারা।
শুক্রবার সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে যখন সৃঞ্জয়ের জেরাপর্ব চলছিল, তখনই নিজাম প্যালেসে সিবিআই-এর দুর্নীতি দমন শাখার একটি দল হলদিয়া বন্দরের দুই অফিসারের বক্তব্য রেকর্ড করেছে। হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাসে সৃঞ্জয়ের সংস্থার একচেটিয়া কারবার নিয়ে প্রায় ১০০টি প্রশ্ন অফিসারদের ধরিয়েছেন সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা। পাশাপাশি, ফরাসি যৌথ উদ্যোগের সংস্থা এবিজিকে কী ভাবে হলদিয়া থেকে তাড়ানো হয়েছিল, তা-ও খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছে সিবিআই। দুই অফিসার তাঁদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে না পারায় শুক্রবার সন্ধ্যাতেই কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁর কাছে যান সিবিআইয়ের এসপি নগেন্দ্র প্রসাদ এবং মামলার তদন্তকারী অফিসার অনিল কুমার।
বন্দর সূত্রের খবর, হলদিয়া ও কলকাতা বন্দরের পণ্য খালাস কেলেঙ্কারি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা না করলে একাধিক কর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে চেয়ারম্যানকে জানিয়ে দিয়েছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার প্রাথমিক হিসেব, বেআইনি লাইসেন্সের ভিত্তিতে পণ্য খালাস করায় গত আট-নয় বছরে বন্দরের অন্তত ২৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। বিশদে এই রাজস্ব ক্ষতির খোঁজ পেতেই বন্দরের অফিসারদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন তাঁরা। সিবিআই সূত্রের খবর, সরকারের রাজস্ব ক্ষতির নেপথ্যে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সবাইকেই এই তদন্তের আওতায় আনা হবে। এ ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের তালিকায় যেমন বন্দরের বেশ কয়েক জন অফিসারের নাম রয়েছে, তেমনই রয়েছে তৃণমূল সাংসদের পণ্য খালাসকারী সংস্থা রিপ্লে অ্যান্ড কোম্পানির বেশ কয়েক জন ডিরেক্টরও। সিবিআই সূত্রের খবর, এই তদন্তে তৃণমূলের প্রাক্তন রাজ্যসভার সদস্য তথা সৃঞ্জয়ের বাবা স্বপনসাধন (টুটু) বসু এবং ভাই সৌমিক বসু (টুবলাই)-এর ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গত ২০ নভেম্বর কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠিতে সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখার অফিসার অনিল কুমার জানিয়েছেন, রিপ্লে অ্যান্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু (প্রিলিমিনারি এনকোয়ারি) করেছে সিবিআই। ২০০৬-’০৭ সালে এই সংস্থা কী ভাবে বন্দরে ঢুকে পণ্য খালাসের কাজ করার লাইসেন্স পেয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিবিআইয়ের বক্তব্য, ১৯৬৩ সালের ‘মেজর পোর্ট ট্রাস্ট’ আইনের ৪২ এবং ৪৮ নম্বর ধারায় পণ্য খালাসকারী সংস্থা নির্বাচন এবং তাদের কাজের পদ্ধতি নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে। হলদিয়া এবং কলকাতা বন্দরে পণ্য খালাসের ব্যাপারে রিপ্লে সংস্থাকে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সেই নির্দেশ ঠিক মতো মানা হয়নি। ফলে গত কয়েক বছরে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে বলে মনে করছে সিবিআই। এবং এই বিষয়টি নিয়েই তারা তদন্ত শুরু হয়েছে। ২০০৭ সালে হলদিয়া বন্দরের ৪বি এবং ২ নম্বর বার্থে যন্ত্র বসিয়ে পণ্য খালাসের বরাত রিপ্লে কোম্পানি কী ভাবে পেয়েছিল, তা-ও জানতে চেয়েছে সিবিআই।
এ ব্যাপারে রিপ্লের অন্যতম কর্ণধার সৌমিক বসুকে যোগাযোগ করা হলে ফোনে ধরা যায়নি। এসএমএসেরও জবাব দেননি তিনি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, “রিপ্লে অন্তত ৫০ বছর ধরে জাহাজ-বন্দর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। লাইসেন্স প্রথা তো সারা দেশেই চলে। বন্দরের নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছে তারা। ফলে এখন সিবিআই তদন্ত কোন যুক্তিতে হচ্ছে, তা তদন্তকারী সংস্থাই বলতে পারবে।”
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর গুজরাতের ভারুচের সাংসদ মনসুখভাই বাসব তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠি দিয়ে হলদিয়া-সহ দেশের ১২টি বৃহৎ বন্দরের পণ্য খালাসে দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেন। তাঁর অভিযোগ, পণ্য খালাস ব্যবস্থায় গলদ থাকায় সবক’টি বন্দর মিলিয়ে বছরে ২ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে কেন্দ্র। অবিলম্বে বিভিন্ন বন্দরের একচেটিয়া কারবারে রাশ টেনে নিলামের মাধ্যমে পণ্য খালাসকারী সংস্থা বাছাই হওয়া উচিত বলে দাবি জানান তিনি। টুজি, কয়লা কেলেঙ্কারির পর এমন অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন এবং সিবিআই। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই তদন্ত গতি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর এ নিয়ে সিবিআইকে সক্রিয় হতে বলায় গত ১৭ জুন তদন্তকারী সংস্থাটি বিভিন্ন বন্দরের চেয়ারম্যানের কাছে ১৬ দফা প্রশ্ন পাঠায়। তখন থেকেই কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাস নিয়ে খোঁজ শুরু হয়। বেশ কয়েক দফায় সিবিআই অফিসারেরা বন্দরে যান। শেষ পর্যন্ত ‘বেআইনি লাইসেন্স’ নিয়ে পণ্য খালাসের অভিযোগে নির্দিষ্ট ভাবে রিপ্লে-র বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে তারা।
যে লাইসেন্স নিয়ে অভিযোগ তুলেছে সিবিআই, সেটি আসলে কী?
বন্দর সূত্রের খবর, ১৯৬৩ সালের ‘মেজর পোর্ট ট্রাস্ট’ আইনের ৪২ নম্বর ধারায় বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে পণ্য খালাসকারী সংস্থা নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। এই ধারা মোতাবেক বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনও সংস্থাকে ফি নিয়ে পণ্য খালাসের লাইসেন্স দিতে পারে। আবার ওই ধারাতেই বলা হয়েছে, ‘এই লাইসেন্স দেওয়ার আগে স্বচ্ছতার সঙ্গে পণ্য খালাসকারী সংস্থা নির্বাচন করতে হবে। চূড়ান্ত লাইসেন্স দেওয়ার আগে জাহাজ মন্ত্রকের অনুমতি নেওয়াও বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি, বন্দর অনুযায়ী পণ্য খালাসের যে দর মন্ত্রক নির্দিষ্ট করে দেয়, সেই দরেই লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থার পণ্য খালাস করার কথা’।
বন্দর-কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে পণ্য খালাসকারী সংস্থা নির্বাচন ‘স্বচ্ছতার’ সঙ্গে হয় না। কর্তৃপক্ষ পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিযোগিতা তৈরি করতে না পারায় পুরো কারবারের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে দু’একটি সংস্থার হাতে। যে সংস্থা সামান্য টাকা জমা দিয়ে এই বার্ষিক লাইসেন্স জোগাড় করছে, তারাই আবার বন্দরের নির্দিষ্ট করে দেওয়া দরের চেয়েও বেশি টাকা নিয়ে পণ্য খালাস করছে বলে অভিযোগ তাঁদের।
বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ বলেন, “সিবিআই প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে। তাই এ নিয়ে কিছু বলব না। সিবিআই এ নিয়ে যা যা তথ্য চাইবে, আমরা দেব।”
জাহাজ মন্ত্রক সূত্রের খবর, হলদিয়া বন্দরের ২ এবং ৮ নম্বর বার্থে দরপত্র চেয়ে এবিজি-এলডিএ নামে এক সংস্থাকে নির্বাচন করে যন্ত্রনির্ভর পণ্য খালাসের বরাত দেন কর্তৃপক্ষ। তাতে কেবল ওই দু’টি বার্থ থেকেই বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় হচ্ছিল বন্দরের। হলদিয়ায় এমন ১২টি বার্থ রয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থা পছন্দ হয়নি দীর্ঘ দিন ধরে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পণ্য খালাসকারী সংস্থাগুলির। এবিজি-র অভিযোগ, এই ধরনের সংস্থার ‘কুমতলবের জেরে’ই তাদের শেষ পর্যন্ত হলদিয়া ছাড়তে হয়। এবিজি-বিদায় যে পণ্য খালাসকারী সংস্থার সঙ্গে জাহাজ মন্ত্রকের শীর্ষ স্তরের একাংশের অশুভ আঁতাঁতের ফলেই হয়েছিল, তা-ও ওই সংস্থা বারবার জানিয়েছিল। বন্দর- কেলেঙ্কারির খবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে পৌঁছেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy