রায়গঞ্জের বাড়িতে সমরেশবাবুর শ্বশুর অর্ধেন্দুশেখর সরকারের কোলে তাঁর মেয়ে নম্রতা। বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
ঠিক কার ছোড়া গুলিতে মালদহে আরপিএফ কর্মী সমরেশ সামন্তের মৃত্যু হল দ্রুত তা তদন্ত করে প্রকাশ্যে আনার দাবি তুললেন নিহতের পরিবারের লোকজনেরা।
সেই সঙ্গে, অবিলম্বে গুলি চালনার ঘটনায় অভিযুক্তদের চিহ্নিত, ক্ষতিপূরণ ও সমরেশবাবুর স্ত্রী পম্পাদেবীর চাকরির দাবিও তুলেছেন তাঁরা। রায়গঞ্জের বিধাননগর এলাকার বাসিন্দা নিহত সমরেশবাবুর শেষকৃত্যে সম্পন্ন করে মঙ্গলবার গভীর রাতে রায়গঞ্জে ফেরেন তাঁর পরিবারের লোকজনেরা। স্বামীর মৃত্যুর পর তিন বছরের মেয়ে নম্রতাকে নিয়ে বিধাননগর এলাকার ফ্ল্যাটে ফিরতে চাননি পম্পাদেবী। আপাতত তিনি মেয়েকে নিয়ে রায়গঞ্জের সুভাষগঞ্জ এলাকার বাপের বাড়িতে রয়েছেন।
বুধবার দুপুরে পম্পাদেবীর বাপের বাড়িতে গিয়ে তাঁর দেখা মেলেনি। পম্পাদেবীর বাবা পেশায় পুলিশকর্মী অর্ধেন্দুশেখর সরকারকে দেখা গেল নাতনি নম্রতাকে কোলে নিয়ে বাড়ির সামনে পায়চারি করছেন। অর্ধেন্দুবাবু বলেন, ‘‘বাড়িতে ফিরে মেয়ে নিজেকে প্রায় ঘরবন্দি করে ফেলেছে। কেউ ওর সঙ্গে দেখা বা কথা বলতে গেলেই কেঁদে ফেলছে। তাই আমরা ওকে বিরক্ত করছি না।’’ এ কথা বলার পরেই সদ্য স্নাতক, একমাত্র ছেলে দীপেন্দুর দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলেন অর্ধেন্দুবাবু ও তাঁর স্ত্রী রুমাদেবী। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে যান তাঁদের ছোটমেয়ে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী দীপাও। তাঁরা জানান, তিন বছরের মেয়েকে কীভাবে মানুষ করবে তাঁদের মেয়ে তাই ভেবে পাচ্ছে না কেউ। নিহত সমরেশবাবুর শ্বশুরমশাই অর্ধেন্দুবাবু বলেন, ‘‘কোনও হকার না আরপিএফ কর্মী, ঠিক কার ছোড়া গুলিতে জামাইয়ের মৃত্যু হয়েছে তা দ্রুত প্রকাশ্যে আনার জন্য মঙ্গলবার মালদহ জেলা পুলিশ ও আরপিএফ কর্তাদের কাছে দাবি করেছি। অভিযুক্তের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই শান্তি পাব না।’
রুমাদেবী জানান, দ্রুত তদন্ত শেষ না হলে সরকারি নিয়মে মেয়ে পম্পাদেবী ক্ষতিপূরণ ও চাকরি পাবে না। মেয়ে ও নাতনির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ‘‘বাবা যে নেই, সে কথা বোঝার মতো এখনও বুদ্ধি হয়নি নম্রতার। তবে সে কিছু একটা আঁচ করতে পেরে এ দিন সকাল থেকে বার বার বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবা কবে আসবে, সেকথা মায়ের কাছে বারবার জানতে চাইছে।’’
অর্ধেন্দুবাবু ও রুমাদেবী জানান, গত রবিবার দুপুরে জামাইষষ্ঠীর অনুষ্ঠান সেরে কাজে যোগ দিতে মালদহে চলে যান জামাই সমরেশ। তাঁর কথায়, ‘‘জামাইকে দুদিন থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু কাজে যোগ দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি বলে চলে যায়। থেকে গেল হয়তো, আমাদের সবাইকে ছেড়ে এ ভাবে চলে যেতে হত না।’’
সমরেশবাবুর বাবা পেশায় অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী অরুণবাবু তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে শহরের নেতাজি সুভাষরোড এলাকার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। তিনি বলেন, ‘‘ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না। কিন্তু কারোর গাফিলতি বা দোষে ছেলের মৃত্যু হয়ে থাকলে, সে শাস্তি পেলেই আমরা শান্তি পাব।’’ তবে সমরেশবাবুর মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা পরেও তদন্তে কার্যত অন্ধকারে পুলিশ। এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রেফতারও হয়নি। বুধবারও স্টেশন চত্বরে দেখা মেলেনি হকারদের। হকার সংগঠনের দাবি, আতঙ্কে বহু হকার আর আসছেন না। সোমবার হকার-আরপিএফ সংঘর্ষে ব্যারাকের মধ্যে গুলিতে মৃত্যু হয় সমরেশবাবুর। এই ঘটনায় ২০০ জন হকারের নামে ইংরেজবাজার থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে আরপিএফ। সেই আতঙ্কেই হকারেরা এলাকা ছাড়া রয়েছেন। ওই দিনের সংঘর্ষে আরপিএফেরা কেন গুলি চালিয়েছিল তা নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
প্রথমে আরপিএফের তরফে ইটের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হলেও, ময়নাতদন্তে সময় প্রকাশ্যে আসে গুলিতে মৃত্যু হয়েছে সমরেশবাবুর। এই ঘটনায় ব্যপক হইচই পড়ে যায়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলিও দাবি করে তাঁদের নিজেদের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে ওই জওয়ানের। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, তাঁর বাম গালে গুলি লেগে মাথা ফুঁড়ে বেড়িয়ে যায়।
ময়নাতদন্তে সময় পুলিশের তরফ থেকে মৃতদেহের ক্ষতস্থানের ছবি তুলে রাখা হয়েছে। পুলিশের এক কর্তা জানান, ঘটনাটি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ আরপিএফের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে হকারদের গুলি থেকেই ওই জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। যদিও ফুটেজে হকারদের গুলি চালাতে দেখা যায় নি বলে জানিয়েছেন তিনি। তাই তদন্ত করেই ধরপাকড় শুরু করতে চাইছেন তাঁরা। এ দিনও স্টেশন প্রায় সুনসান ছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy