নোট তো নয়, যেন এক-আধখানা বই! হিটলার জমানার কথা মুখস্থ করবে? না প্যান্ডেলে যাওয়ার কথা ভাববে?
ভাইটা এখন থেকেই নতুন নীল জুতো, জামা পেয়ে মশগুল। এক কানে দুল পরে নাচ প্র্যাকটিস করতে লেগেছে। সামনের তিন-চারটে দিন খুঁজেই পাওয়া যাবে না ওকে।
দশ বাই বারো ফুট ঘরের শারদ-সন্ধ্যা। অস্ফুট এমএ পার্ট ওয়ানের আগমনী ধ্বনি। খাটময় তাড়া-তাড়া নোটের গোছা। পুজোর দিন সাতেকের মধ্যেই শুরু হবে মহাসংগ্রাম। পড়তে পড়তে রোগা মেয়েটার তবু তাল কেটে যায়। ঝুমা সরকার বিড়বিড় করেন, ‘‘প্যান্ডেলে একবারটি যেতেই হবে, ঠিক! একসঙ্গে আমরা চার জন।”
বছর দেড়েক আগে ঘরে আসা টিভির পিছনে ঢাকা-পড়া ছবির ফ্রেমেও সেই চার জন। ভাইটা তখন এত লম্বা ছিল না। বাবার চুলগুলো আরও ঘন, ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া। সে-বার প্যারোলে পাঁচ না সাত দিনের ছুটি পেয়ে ঘরে এসেছিল বাবা। রাজচন্দ্রপুর বাজারের স্টুডিওতে গিয়ে ছবিটা তোলা। এই পুজোয় চার জন মিলে একসঙ্গে একটা ছবি তুলতে বড় সাধ হয়!
ঝুমার কিছু ইচ্ছে হলে তা অবশ্য ঠেকানো মুশকিল। হাইকোর্টের উকিল জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় তা বিলক্ষণ জানেন। জেল কয়েদিদের ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’য় প্রথম দস্যু জগৎ সরকারের মামলাটা তিনিই লড়েছিলেন কি না! ঝুমা তখন চুপটি করে হাইকোর্টে তাঁর চেম্বারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকত। কখনও বলত না, স্যার আমার বাবা কবে ছাড়া পাবে? কিন্তু ওই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার একটা অদ্ভুত শক্তি ছিল। জয়ন্ত বলেন, মেয়েটাকে দেখলে আমি কেমন চাপে পড়ে যেতাম!
বাবার কেস লড়ার যাবতীয় টাকা ছাত্র পড়িয়ে ওই মেয়েই তুলে দিয়েছিলেন। তবে জিজ্ঞেস করলে রবীন্দ্রভারতীর এমএ-র ছাত্রীটি বলেন, টিউশনের টাকায় কি হাইকোর্টের কেস লড়া যায়? সে তো লাখ টাকার ধাক্কা। এই উকিলবাবু সত্যিই ভাল, নইলে দশ বছরে কম উকিল তো দেখিনি আমরা!
মাধ্যমিকে একটুর জন্য প্রথম ডিভিশন হয়নি। ক্লাস ইলেভেন থেকেই ছাত্র পড়ান। এইট অবধি সব সাবজেক্ট, মাধ্যমিকের সায়েন্স গ্রুপ পড়িয়ে নিজের পড়াশোনা। একার চেষ্টাতেই সব। নইলে বাবা-মা-ভাই কেউই স্কুলের গণ্ডি ছাড়াননি।
তবে সহজাত ক্ষমতার ব্যাপারটা রক্তে ছিল। বাবা জগৎ সরকার জাত-শিল্পী। জীবনে কোথাও কারও কাছে কিছু শেখেননি। কিন্তু পাথর কুঁদে প্রাণ দিতে জানেন। গানের গলাও দরাজ। অলকানন্দা রায়ের ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’য় জগৎ ‘প্রথম দস্যু’। দস্যুদলের সব গান তাঁরই গাওয়া। তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন জয়ন্তবাবু। তাঁর হয়ে মামলা লড়ার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু মেয়েকে দেখে ইচ্ছেটুকু এ বার তাগিদ হয়ে ওঠে।
মামলা চলেছিল তিন বছর। বাবার জন্য হাজার পঁচিশেক খরচা হয়েছিল মেয়ের। জয়ন্ত বলেন, ‘‘সত্যি বলতে ওই বাচ্চার কাছে টাকা নিতে লজ্জাই করত! কিন্তু মেয়েটা ঠিক সময় যখন যা পারে নিয়ে হাজির!’’ হাইকোর্টে বেকসুর খালাস পান জগৎ। দশ বছর আগে বন্ধু শক্তি চক্রবর্তীকে খুনের ভার থেকে মুক্তির স্বাদ। জজসাহেবের রায় শুনে উকিলেরও চোখে জল। বাচ্চা মেয়েটা শুধু ঠোঁট কামড়ে থাকে। মিষ্টির বাক্স হাতে নিঃশব্দে প্রণাম করে।
বালির রাজচন্দ্রপুর প্রফুল্লনগরের টালির ঘরটায় নিচু স্বরে কথা বলেন ঝুমা। “আমি তখন ক্লাস সেভেন! রেললাইনের ধারে শক্তিকাকুর বডিটা পড়েছিল। ছুট্টে দেখতে গেছিলাম। ফিরে শুনি, আমার বাবাকে নিয়ে গেছে পুলিশ।” বাবা যে কিছু করেননি সেই বিশ্বাসটা টাল খায়নি শুরু থেকে শেষ অবধি। বাবাকে ফিরিয়ে আনার জেদটাও তখনই দানা বাঁধে।
কিন্তু এক বছরের মধ্যে যাবজ্জীবন সাজা হয়ে গেল জগতের। হাওড়ার সাব-জেল থেকে ঠিকানা প্রেসিডেন্সি। তখন ট্রেনে করে বরাহনগর হয়ে ২৩০ নম্বর বাসে চেপে বাবাকে দেখতে যেতে হতো। পুজোর পরে বাবা দাঁড়িয়ে থাকত জালে-ঘেরা গেটের ও পারে। প্রণাম করার পা-টা কোথায় পাব?
সেই বাবা এখন মূর্তিমান চোখের সামনে। দশ বছর বাদে পুজোয় একজোট পুরো পরিবার। তবু আবেগে ভাসতে নারাজ মাঝ চল্লিশের পেটানো চেহারা। “দশ-দশটা বছর পিছিয়ে পড়েছি, বুঝলেন। ওয়াইফ লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার টেনেছে। এখনও সল্টলেকে রাত অবধি আয়ার কাজ করে। ওকে বাড়িতে পাবেন না!”
ছেলেটা পড়াশোনা শিখল না। বাচ্চার মতো বায়না ধরে। কিন্তু মেয়েকে দেখলে বুক ভরে যায় বাবার। “উকিলবাবুরা তো কম ব্যস্ত নয়। ও নিজে লেগে না-থাকলে আমার কেসটাও এখন কোথায় পড়ে থাকত।”
ঘরের লোককে এ বার কিছু ফেরাতে হবে তো! জগৎ চিন্তা করেন, মেয়েটা বিএড পড়তে চায়। সরকারিতে সুযোগ না-পেলে অনেক খরচ।
পাথর-ছেনি-হাতুড়ি বা সুরের জগৎ তাই অনেক দূর। কাকভোরে উঠে জগৎ ইট-বালি-সুরকি বোঝাই ভ্যান ঠেলেন। অভয়নগরের বাজারটা দুপুরে একা হাতে ঝাড়পোঁছ করে তকতকে করে তোলা। ভরসন্ধেয় ঘরের পাশে পাগলের মতো মাটি সরান, জঞ্জাল সাফ করেন। একটামাত্র ঘর। আর একটা চালা তুলতে হবে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। মেয়েটা রাতে ওর দিদার কাছে শুতে যায়!
এই বাবাকে দেখে ছেলেমানুষের মতো মায়া হয় ঝুমার। ই-স্ কত দিন একটু বসে গান করে না বাবা। অলকানন্দা রায় বাবাকে ছেলের মতো ভালবাসেন। কোথায় যেন নিয়ে গিয়েছিলেন গানের জন্য। কিন্তু বাবা বলল, খেটে না-খেলে হবে না!
জেলেও এমন খেপ খাটতেন জগৎ। দুপুরে সবাই খেয়েদেয়ে গুলতানি মারছে, আর জগৎ পাথর ঠুকে চলেছেন। পাশেই থাকতেন এক বয়স্ক কাকু। বালি-সিমেন্টের মূর্তি গড়তেন। তাঁকে দেখেই পাথর ঘষার সাধ জাগল। একটা ছেনি নেই! মশলা পেষার পাথরে লোহার টুকরো নিয়ে একটানা মরিয়া কসরত। কী করে পাথরে চোখমুখ ফোটাতে হয়, জানেন না। কখনও কাউকে দেখেনওনি! বিকেল চারটে বেজে যাচ্ছে। তবু মনে-মনে পাথরকে বলতেন, আমার তো সাজার শেষ নেই, লাইফ টাইম দিয়েছে! আমিও তোমায় ছাড়ব না।
জগতের হাতের বুদ্ধমূর্তি বা রবীন্দ্রনাথ এখন পুলিশের আইজি থেকে শুরু করে কত জনের ঘরে-ঘরে। বাড়ির মন্দিরের শিব-পার্বতীরও জেলেই জন্ম।
আর পিছনে তাকাতে চান না ঝুমার বাবা। বলেন, ক-ত রকম মানুষ দেখলাম। কারও ওপর রাগ নেই। পাথরের কাজ শেষে সব ধুয়ে ফেলতে হয়। তখন তার অন্য রূপ!
জীবন তো পাথরের মতোই গড়ে-পিটে নেয়। বাবার খুব প্রিয় ভবা পাগলার একটা সুর ঝুমার মনে গুনগুন করে। এই মানুষ দেবতা হয়, হয় অবতার / ভবা কয় চোখ মেলে চেয়ে দেখ মন...
বাবার দেওয়া সস্তার রুপোলি সালওয়ার কামিজটা বুকে জড়িয়ে ধরেন ঝুমা। এত বছর বাদে ফিরে পাওয়া বাবাকে আরও ভালবাসতে ইচ্ছে করে। খাটের ওপর ফরফর করে ওড়ে ইতিহাসের নোট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy