Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্বাসে ভর, জালন্ধরের আলুবীজ এনেই ভরাডুবি

পঞ্জাবের জালন্ধর থেকে দামী বীজ এনে সর্বস্বান্ত হতে বসেছেন এ রাজ্যের আলুচাষি ও আলুবীজ ব্যবসায়ীরা। ভাইরাস-যুক্ত আলুবীজের দাপটে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা-সহ রাজ্যের তিন জেলার চাষিরা বিপাকে। বৈধ ‘সার্টিফিকেট’ ছাড়া অন্য কোনও কিছুই যথেষ্ট রক্ষাকবচ হতে পারে না, সেই ধারণা তাঁদের অনেকেরই ছিল না। যাঁদের ধারণা ছিল, তাঁরাও যে ভাবেই হোক জালন্ধরের বীজ পাওয়ার জন্য সেখানকার ব্যবসায়ীদের কথায় বিশ্বাস করেছেন। আর তাতেই কাল হয়েছে।

ফসলের ক্ষতির আশঙ্কায় চাষি।—নিজস্ব চিত্র।

ফসলের ক্ষতির আশঙ্কায় চাষি।—নিজস্ব চিত্র।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
আমলাগোড়া শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১৯
Share: Save:

পঞ্জাবের জালন্ধর থেকে দামী বীজ এনে সর্বস্বান্ত হতে বসেছেন এ রাজ্যের আলুচাষি ও আলুবীজ ব্যবসায়ীরা।

ভাইরাস-যুক্ত আলুবীজের দাপটে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা-সহ রাজ্যের তিন জেলার চাষিরা বিপাকে। বৈধ ‘সার্টিফিকেট’ ছাড়া অন্য কোনও কিছুই যথেষ্ট রক্ষাকবচ হতে পারে না, সেই ধারণা তাঁদের অনেকেরই ছিল না। যাঁদের ধারণা ছিল, তাঁরাও যে ভাবেই হোক জালন্ধরের বীজ পাওয়ার জন্য সেখানকার ব্যবসায়ীদের কথায় বিশ্বাস করেছেন। আর তাতেই কাল হয়েছে।

জালন্ধর থেকে বীজ এনেছিলেন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা। চাষিরা তাঁদের থেকেই বীজ কিনেছেন। ফলে বিপর্যয়ের পরে প্রাথমিক ভাবে স্থানীয় কারিবারিদের উপরেই চাষিদের রাগ গিয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুরের আমলাগোড়া অঞ্চলে ভুক্তভোগী চাষিরা ব্যবসায়ীদের আড়তে হামলা করেছেন। ভয়ে অনেকেই ঘরছাড়া। জালন্ধরের একটি বড় বীজ কোম্পানির অফিস ছিল হুগলির তারকেশ্বের। গণ্ডগোলের আশঙ্কায় সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু ইতিমধ্যে নবান্নে আলুবীজ সংগঠনের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে তাঁর নিজেরই সংশয়, “কেউ যদি জেনে বুঝেই ভিন্‌ রাজ্য থেকে সার্টিফিকেট ছাড়া বীজ আনে, সরকারি স্তরে সেই নিয়ে কথা বলার খুব কিছু থাকে না।”

কিন্তু কেন এমন হল?

গত মরসুমে রাজ্য সরকার আলু রফতানি নিয়ন্ত্রণ করায় চাষি এবং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এ বার রাজ্যের অন্যতম প্রধান আলু উত্‌পাদক জেলা হুগলি, বর্ধমান আর নদিয়ার বেশ কিছু চাষি কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগাম টাকা দিয়েও বীজ পাননি। তাই অনেকেই জালন্ধর থেকে ভাল বীজ এনে আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার জন্য মরসুমের শুরুতেই প্রতি বিঘায় ২৫ হাজার টাকারও বেশি খরচ করেছেন চাষিরা। সাধারণ নিয়ম অনুয়ায়ী, ভিন্‌ রাজ্য থেকে বীজ এ রাজ্যে এলে তা ‘সার্টিফায়েড’ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু জালন্ধর থেকে ‘কে-২২’ প্রজাতির যে বীজ আনার জন্য ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন, তার বেশির ভাগই সার্টিফায়েড নয়।

সরকারি নিয়ম হল, যে রাজ্যের ফার্মে বীজ তৈরি হচ্ছে তা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কৃষি দফতর পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দেবে। তার পর সেটি বাজারে আসবে। কিন্তু কোনও রাজ্যের সরকারই এই বিষয়ে সচেতন নয়। আইন বাঁচাতে জালন্ধরের বীজের প্যাকেটে ‘ট্রুথফুল’ পটেটো বা পটেটো টিউবার লেখা থাকে। বিষয়টি জেনে-বুঝেও এ রাজ্যের বীজ কারবারিরা ‘সার্টিফায়েড’ নয় এমন বীজ নিতে রাজি হলেন কেন? বীজ ব্যবসায়ী মহলের বক্তব্য, জালন্ধরের ফার্মগুলি যে বীজ তৈরি করে তা গোটা দেশে, এমনকী বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানেও যায়। তাদের বীজের চাহিদা একচেটিয়া। তা পেতে গেলে নিয়মরীতির কথা বেশি তোলা যায় না। সেই ফাঁক গলেই খারাপ বীজ ঢুকে চাষে ভরাডুবি ঘটিয়েছে।

কেমন ভরাডুবি?

বীজ লাগানোর পরে যে চারা বেরোচ্ছে তার পাতা কুঁচকে ছোট হয়ে যাচ্ছে। গাছ বাড়ছে না। চাষিরা স্থানীয় ভাষায় বলছেন, আলু গাছের ‘কুটে’ রোগ ধরেছে। শেষ পর্যন্ত গোড়া পচে গাছ মরে যাচ্ছে। আমলাগোড়ার পরিস্থিতি এমনই যে, প্রচুর টাকা ধার করে ভরাডুবির ফলে ইতিমধ্যেই দুই চাষি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। যে চাষিরা রাতপাহারা দিয়ে খেত রক্ষা করেন, এখন তাঁরাই চারা উপড়ে ফেলছেন। খুনবেড়িয়া গ্রামের চাষি তথা স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য আদিত্য কর্মকার জমিতে দাঁড়িয়েই কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “দলমত নির্বিশেষে সব চাষি পথে বসেছে শুধু পঞ্জাবের খারাপ বীজের জন্য। সরকার কিছু করুক। নইলে আমরা বউ-বাচ্চা নিয়ে প্রাণে মরব।”

কম-বেশি একই অবস্থা পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশ কয়েকটি গ্রামের চাষিদের। জালন্ধরের একটি সংস্থা থেকে ‘কে-২২’ প্রজাতির আলু কেনার জন্য ওঁরা ছ’মাস আগে আগাম দিয়েছিলেন। মূলত বাঁকুড়ায় ওই আলুর বাজার আছে। বীজ যাতে খারাপ না হয় তার জন্য রাজ্যের ব্যবসায়ীরা বারবার জালন্ধরে গিয়ে সংস্থার কর্তাদের সতর্কও করেন। তার পরেও এই হাল। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে আবহাওয়া অনুকূল থাকলেও ফের আলু চাষের রসদ নেই চাষিদের।

আমলাগোড়ার চাষি মিল্টুলাল গিরি বলেন, “সমবায় থেকে ধার নিয়েছি। চাষে নেমে টাকায় কুলোয়নি। শেষমেশ মহাজন-বন্ধুবান্ধবদের থেকে টাকা নিয়ে লাগিয়েছি। শেষ হয়ে গেলাম!” ওই এলাকারই প্রবীণ চাষি নন্দ গিরি বলেন, “দেড় লক্ষ টাকা চাষের কাজে লাগিয়েছিলাম। বাড়িতে ১৬টা পেট। কলেজে পড়ে দু’জন। আমি কী করে চালাব? ছেলে-স্ত্রী সবাই আমাকে দুষছে। এত শীতেও বাড়িতে ঢুকতে পারছি না এই বয়সে” বলতে-বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

আলু বীজ ব্যবসায়ীদের হালও খারাপ। আক্রান্ত হয়েও চাষিদের মানসিক অবস্থার কথা ভেবে তাঁরা পুলিশি ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। আমলাগোড়ার ব্যবসায়ী চন্দন বাজপেয়ী বলেন, “আমরা ৯০ শতাংশ চাষিকে মূলত ধারে বীজ সরবরাহ করি। আলু উঠলে ওঁরা টাকা শোধ করেন। এখন যা পরিস্থিতি, চাষিরা আমাদের টাকা দেবেন কী করে? আমরাই বা টাকা চাইব কী ভাবে?” সব মহলেই প্রশ্ন উঠেছে, পঞ্জাবের সংস্থা কেন এমন খারাপ বীজ পাঠাল? কিন্তু বীজ ‘সার্টিফায়েড’ না হওয়ায় আইনি রাস্তায় তাদের চ্যালেঞ্জ করার রাস্তাও তেমন নেই।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, জালন্ধরের ব্যবসায়ীরা বিশ্বাসভঙ্গ করবেন, তা তাঁরা ভাবতে পারেননি। কৃষিমন্ত্রী বলেন, “যেখানে চাষিরা বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাঁদের আমরা যতটা সম্ভব বিকল্প বীজ দেওয়ার চেষ্টা করছি।”

তাতে কাটা ঘায়ে কতটা মলম পড়ে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

potato goutam bondyopadhyay amlagora
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE