Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বেহাল অঙ্গনওয়াড়িতেই হাজার ‘শিশু আলয়’

নিজের ঘর নেই বেশির ভাগের। যাদের আছে, তাদেরও এতই ছোট যে গাদাগাদি করে বলতে হয় শিশুদের। মাথার উপরে পাখা নেই অনেকগুলিরই। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকার অভাব সর্বত্র।

মেমারি ২ ব্লকে চলছে ‘শিশু আলয়’ সাজানোর কাজ চলছে জোরকদমে। —নিজস্ব চিত্র।

মেমারি ২ ব্লকে চলছে ‘শিশু আলয়’ সাজানোর কাজ চলছে জোরকদমে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বর্ধমান ও ডোমজুড় শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৩৯
Share: Save:

নিজের ঘর নেই বেশির ভাগের। যাদের আছে, তাদেরও এতই ছোট যে গাদাগাদি করে বলতে হয় শিশুদের। মাথার উপরে পাখা নেই অনেকগুলিরই। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকার অভাব সর্বত্র।

তারই মধ্যে রাজ্যের এক হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আজ, শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ প্রকল্প, যার লক্ষ্য একেবারে শিশুদের যত্ন ও শিক্ষার ব্যবস্থা পাকা করা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যার নাম দিয়েছেন ‘শিশু আলয়’। এ দিন দুপুর ১২টায় হাওড়ার ডোমজুড়ে রুদ্রপুর পান্থশালা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র লাগোয়া মাঠে তার উদ্বোধন করবেন রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা।

বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত সরকারি অনুষ্ঠান ঘিরে তোড়জোড় ছিল তুঙ্গে। হাওড়া জেলা শিশু বিকাশ দফতরের এক কর্তা জানান, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিশুদের হাতে দেওয়া হবে বাক্সভর্তি উপহার। শিশুদের আকর্ষণ করতে আলয়গুলির ঘরের দেওয়াল নানা রঙে রাভিয়ে তোলা হচ্ছে। আনা হচ্ছে আধুনিক ওজন মাপার জন্য, হরেক খেলনা। রোজের রান্না যাতে ভাল হয়, সে দিকেও কড়া নজর রাখা হবে।

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির বেশির ভাগের যা অবস্থা, তাতে এই উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেই প্রশ্ন কিন্তু এড়ানো যাচ্ছে না।

বর্ধমানে মেমারি ২ ব্লকের ৫০টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে প্রাথমিক ভাবে এই প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। সেগুলিকে ‘মডেল’ করে ভবিষ্যতে এগোতে চায় জেলা প্রশাসন। সুসংহত শিশু বিকাশ কেন্দ্র (আইসিডিএস) প্রকল্পের জেলা আধিকারিক অনুপম দত্ত বলেন, “এত দিন শিশু ও প্রসূতিদের পুষ্টির উপরেই বেশি জোর দেওয়া হত। এ বার থেকে পড়ানোর উপরেও জোর দেওয়া হবে। খেলাচ্ছলে শিশুদের পড়াতে হবে— এটাই ‘শিশু আলয়’ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।”

সমস্যা হল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের অনেকগুলিরই নিজস্ব বাড়ি নেই। বেশ কয়েকটি চলে প্রাথমিক স্কুলে। যাদের নিজস্ব বাড়ি আছে, তাদের অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। ছোট ঘরের মধ্যেই শিশুদের কার্যত আটকে রাখতে হয়। ‘শিশু আলয়’ প্রকল্পে তাদের অন্তত চার ঘণ্টা রাখতে হবে। ঘরের ভিতরে চারটি কোণ বিষয় অনুযায়ী সাজাতে হবে। চার কোণে বয়স অনুযায়ী শিশুদের বসিয়ে পড়াতে হবে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে তিন থেকে ছয় বছরের শিশুরা যায়। সরকারি নির্দেশ হল, নতুন ব্যবস্থায় প্রতি সপ্তাহে একটি বিষয় বেছে শিশুদের বোঝাতে হবে। তাদের উন্নতি হচ্ছে কি না তারও খেয়াল রাখতে হবে। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হবে এমন শিশুদের শেষ এক ঘণ্টা বিশেষ নজর দিতে হবে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের।

যেখানে গোয়াল ঘরের স্যাঁতসেতে পরিবেশে, খোলা মাঠে ছাগল-মুরগির সঙ্গে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চলে, সেখানে ‘শিশু আলয়’ প্রকল্প চালু হবে কী ভাবে?

বর্ধমান জেলায় ৩৯টি প্রকল্পের আওতায় ৯৬৬৮টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চালু রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় চার হাজার কেন্দ্রের নিজের বাড়ি নেই। ৫৮২টি কেন্দ্র চলছে ভাড়া বাড়িতে, সরকারি জায়গায় ৫৮২টি, প্রাথমিক স্কুলে ১৭৭৫টি, ব্যক্তিগত জায়গায় ১৯৪৫টি। অধিকাংশ কেন্দ্রে পানীয় জল ও শৌচাগারের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। অনেক জায়গায় পাঁচিলের ব্যবস্থা না থাকায় শিশুদের নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন কেন্দ্রের কর্মী ও সহায়িকারা। কর্মী ও সহায়িকার সংখ্যাও অপ্রতুল। বর্ধমানে আটশোর কাছাকাছি কর্মী ও ১৫২০টি সহায়ক পদ ফাঁকা রয়েছে।

মেমারির ২ ব্লকে এক প্রস্তাবিত শিশু আলয়ের কর্মীর কথায়, “বিদ্যুৎ না থাকায় গ্রীষ্মে পাখার হাওয়া পায় না শিশুরা। শীতে ঠান্ডা মেঝেয় ভাল করে বসার জায়গা দিতে পারি না। সেখানে চার ঘন্টা ধরে ওদের এখানে রাখা কি সম্ভব?” ব্লকের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা সংগঠনের নেত্রী মনীষা চক্রবর্তী বলেন, “পরিকাঠামো নেই, উপকরণ নেই। সেখানে এই প্রকল্পে ঘর সাজানোই হবে, কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হয় না।”

হাওড়া জেলা পরিষদের প্রাক্তন পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তথা জেলা সিপিএম নেতা আনন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র সাজিয়ে তোলা অবশ্যই ভাল ব্যাপার। কিন্তু অনেক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মাথাতেই ছাদ নেই। সেগুলি চলে কারও বাড়ির দালানে কিংবা ক্লাবঘরে। ঘটা করে অনুষ্ঠান না করে সেই টাকায় অন্তত একটি ঘরহীন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেত।’’

কেউ কেউ অবশ্য এর মধ্যেও আশাবাদী। মেমারির অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী রূপালি দে যেমন মনে করেন, “নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পড়ানোয় শিশুদের উন্নতি হবে। আমাদেরও নতুন বিষয় নিয়ে পড়াতে ভাল লাগবে। এর ফলে হয়তো শিশুদের মায়েরাও উৎসাহী হয়ে আমাদের কথা শুনবেন, বাড়িতে শিশুদের পড়াতে উৎসাহী হবেন।”

হলে তো ভালই। তবে তার জন্য শিশুদের আগে ছাদের নীচে আরামে বসতে দেওয়া ব্যবস্থা করাটুকুই বোধ হয় সবচেয়ে জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE