Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বিয়ে রোখা জাইনাব মায়ের কাছে অচেনা

পাঁচ বছর পরে ঘরে ফিরেছে মেয়ে। দিনে চাকরি, বিকেলে গৃহশিক্ষকতা। তার পরে নিজের পড়াশোনা। তাই রাত জাগেন জাইনাব। দু’পাশে ভাই সইসাল আর বোন কুলসুম। পড়ছে তারাও।

স্কুলের কাজে ব্যস্ত জাইনাব ফারিন। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

স্কুলের কাজে ব্যস্ত জাইনাব ফারিন। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২১
Share: Save:

পাঁচ বছর পরে ঘরে ফিরেছে মেয়ে।

দিনে চাকরি, বিকেলে গৃহশিক্ষকতা। তার পরে নিজের পড়াশোনা। তাই রাত জাগেন জাইনাব। দু’পাশে ভাই সইসাল আর বোন কুলসুম। পড়ছে তারাও। ঘুম নেই মা রোশনারার চোখে। দাওয়ায় বসে তিনি ভাবছেন, এ-ও কী সম্ভব! কী করে মেয়েটা এত পড়াশোনা শিখল! কী করে কম্পিউটার শিখল! উপার্জন করতেই বা কে শেখাল!

অভাবের সংসারে পাঁচ বছর আগে রোশনারা সিদ্দিকী তো মেয়ের বিয়েই দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! জাইনাব তখন দ্বাদশ শ্রেণি। রোশনারা বলেছিলেন, ‘‘ঢের হয়েছে। পড়াশোনায় আর কাজ নেই। পাঁচ দিন পরেই তোমার নিকাহ্।’’

প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন জাইনাব ফারিন। পড়তে চেয়ে ঘর ছেড়েছিলেন। থানা-পুলিশ, হোম— পড়ার জন্য কিছুই বাদ রাখেননি। বছর বাইশের জাইনাব এখন এমএ-র ছাত্রী। বারাসতের পশ্চিম খিলকাপুর পঞ্চায়েতের ময়না গ্রামের একচিলতে ভাড়াঘরে হোম থেকে ফিরে এসেছেন দিন কয়েক আগে। যে পরিবার ২০১১ সালে নাবালিকা অবস্থায় তাঁর বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিল, সেই পরিবারেরই এখন নয়নের মণি জাইনাব।

জাইনাব বলছেন, ‘‘মা তো মা-ই, তাই না! ভাইবোনকে ছেড়েই বা থাকি কী করে? সাংসারিক অভাব-অনটনে কত যে সমস্যা আসে! তাই বলে থেমে থাকলে তো চলবে না।’’

পুরুলিয়ার শিশু শ্রমিক স্কুলের এক সময়ের ছাত্রী বীণা কালিন্দী, রেখা কালিন্দীর নাম জানেন জাইনাব। পড়তে চেয়ে যারা কম বয়সে বিয়ের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিল। তবে, শুধুই প্রতিবাদে আটকে না থেকে জাইনাব চেয়েছিলেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে।

পরিবার ছেড়ে জাইনাবদের বাবা চলে গিয়েছিলেন সেই কবেই! জাইনাব তখন ছোট। ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাতে রোশনারার নুন আনতে পান্তা ফুরোত। ধার করতেন। শোধ করার কথা ভেবে রাতে কাঁদতেন। বছর পাঁচেক আগে এক প্রতিবেশী যখন রোশনারাকে বললেন, ‘‘টাকা দিচ্ছি, মেয়েটাকে দাও বিয়ের জন্য’’—বাধ্য হয়ে তাতে সায় দিয়েছিলেন তিনি।

তখন সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক। জাইনাব প্রস্তুতিতে ডুবে। রোশনারা মেয়ের কাছে বিয়ের কথা পাড়লেন। অশান্তি হল মা-মেয়ের। জাইনাব থানায় গেলেন। ঠাঁই হল হৃদয়পুরের আরাধনা হোমে। জাইনাব তখন বারাসতের ইংরেজি মাধ্যম কল্যাণী পাবলিক স্কুলে পড়তেন। হোম থেকে পড়েই তিনি ৭২ শতাংশ নম্বর নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেন। তার পর বারাসত কলেজ। ইংরেজিতে অনার্স। পড়ার ফাঁকে পশ্চিমবঙ্গ যুবকেন্দ্র থেকে চলল কম্পিউটার প্রশিক্ষণ।

জাইনাব এখন বারাসতের ওই স্কুলেরই কম্পিউটার শিক্ষিকা। মাঝের ক’টা বছর মেয়ের চিন্তায় আকুল হয়েছেন রোশনারা। কিন্তু গিলে খেতে আসা অভাবের ঘরে মেয়েকে ফিরিয়ে এনে কী করবেন, ভেবে পাননি। ঋণ শোধ করতে গিয়ে এর মধ্যে বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন ওই এলাকাতেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। ক’দিন আগে মেয়ে নিজেই ফিরেছেন। আর মা যেন মেয়েকে নতুন ভাবে দেখছেন! রোশনারা বলছেন, ‘‘কেউ যেন শত অভাবেও কম বয়সে মেয়ের বিয়ে না দেন।’’

জাইনাবের এই লড়াইকে কুর্নিশ করেছেন জেলা প্রশাসনে কর্তারা থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রের মানুষ। জাইনাবের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রূপা দে বলেন, ‘‘ও এমএ, বিএড পড়ে আরও বড় হোক। ওঁর অধ্যবসায় চোখে পড়ার মতো।’’ হৃদয়পুরের হোমটির কর্ণধার শ্রাবণী চক্রবর্তী ও সর্বাণী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘জাইনাব দৃ়ঢ় মানসিকতার মেয়ে। হোমে থাকার সময়ে ও অন্য মেয়েদেরও সমান ভাবে সাহায্য করত। ওঁর লড়াই অন্যদের কাছে প্রেরণার।’’

আর জাইনাবের প্রেরণা?

উত্তরটা দিতে গিয়ে হাতে বই তুলে নেন জাইনাব। একটা জীবন-কাহিনি। ‘আই অ্যাম মালালা’। পাকিস্তানের সেই মেয়ে। মালালা ইউসুফজাই। যে শিক্ষার জন্য তালিবানের গুলি খেয়েও দমেনি।

তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান জাইনাব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE