Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
ফের ভোটে সাড়া নেই

ফায়দা কার, শাসক না বিরোধীর? প্রশ্ন সেটাই

মূল ভোটের দিনে ছিল ব্যাপক অশান্তির বাতাবরণ। পুনর্নির্বাচনে সেখানে প্রায় অখণ্ড শান্তি! কিন্তু নির্বাচনের চেয়ে পুনর্নির্বাচনে বিস্তর কমই থাকল ভোটদানের হার।

নিস্তরঙ্গ পুনর্নির্বাচনে খোশমেজাজে উর্দিধারী। শুক্রবার বিধাননগরের এইচবি ব্লকে বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

নিস্তরঙ্গ পুনর্নির্বাচনে খোশমেজাজে উর্দিধারী। শুক্রবার বিধাননগরের এইচবি ব্লকে বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০০:২২
Share: Save:

মূল ভোটের দিনে ছিল ব্যাপক অশান্তির বাতাবরণ। পুনর্নির্বাচনে সেখানে প্রায় অখণ্ড শান্তি! কিন্তু নির্বাচনের চেয়ে পুনর্নির্বাচনে বিস্তর কমই থাকল ভোটদানের হার।

অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নির্দেশে বিধাননগর পুর-নিগমের ৯টি এবং আসানসোলের দু’টি বুথে নতুন করে ভোট নেওয়া হল শুক্রবার। এমনিতেই কয়েকটি বুথের পুনর্নির্বাচন ঘিরে কখনওই সাধারণ ভোটের উৎসাহ থাকে না। তার

উপরে সপ্তাহের শেষ কাজের দিন। তবু এ সব কিছুকে হিসেবের মধ্যে ধরলেও এ দিনের পুনর্নির্বাচনে ভোটদানের হার বেশ ঝিমিয়েই থাকল বলা যায়। এই স্বল্প ভোটদানে আসলে কার ফায়দা— শাসক না বিরোধীর, তা নিয়েও উঠে আসছে নানা মত।

রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিধাননগরের ৯টি বুথে ভোট পড়েছে গড়ে ৩০.০৬%। তার মধ্যে এমন বুথও আছে, যেখানে ভোটদানের হার মাত্র ৮%! তুলনায় আসানসোলের ছবি একটু অন্য রকম। সেখানকার একটি বুথে ভোটের হার ৭২% ছাড়িয়েছে। অন্যটিতে প্রায় ৩৭%। যে হেতু কলকাতার লাগোয়া বিধাননগরের পুরভোট ঘিরেই তুলকালাম বেধেছিল বেশি, সেখানকার পুনর্নির্বাচন নিয়ে তাই চর্চাটা বেশি হচ্ছে। গত ৩ অক্টোবরের ভোটের দিনের মতো এ দিন বিধাননগর জুড়ে বহিরাগতদের দাপাদাপি ছিল না, শাসক দলের নেতা-বিধায়কদেরও বাইরে থেকে এসে দাদাগিরি করতে দেখা যায়নি। পুলিশেরও কার্যত কোনও কাজ ছিল না।

তা হলে মানুষের ভোট দিতে উৎসাহ এত কম কেন?

কেউ বলছেন, এই স্বল্প হারে ভোট আসলে নির্বাচনের নামে প্রহসনের বিরুদ্ধে বিধাননগরের মানুষের নীরব প্রতিবাদ। তাঁরা যে ঘটনাপ্রবাহে বীতশ্রদ্ধ, অধিকাংশ বাসিন্দা আর বুথমুখো না হয়ে সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন। আবার শাসক শিবির মনে করছে, কম ভোট পড়েছে মানে আখেরে তাদেরই মঙ্গল! কারণ, গত শনিবারের পুরভোট ঘিরে হাঙ্গামার পরে যত বেশি মানুষ পুনর্নির্বাচনের বুথে যেতেন, তত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভোট পড়ার সম্ভাবনা বাড়ত। তার চেয়ে কম ভোটেই স্বস্তি।

তবে এ দিনের পুনর্নির্বাচন ঘিরে যথেষ্ট ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তির পরিবেশও ছিল। বহু মানুষ ঠিকমতো জানতেনই না, পুনর্নির্বাচন হচ্ছে এ দিন। একই এলাকায় ছিল একাধিক বুথ। কিন্তু তার মধ্যে ঠিক কোনটায় নতুন করে ভোট হচ্ছে, তা নিয়েও স্পষ্ট খবর ছিল না অনেকের কাছে। কমিশন পুনর্নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেছিল বৃহস্পতিবার বিকেলে। সেই খবর পেয়ে এলাকার বিভিন্ন স্কুল যখন পরের দিন পঠনপাঠন বন্ধ রাখার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তত ক্ষণে সে দিনের মতো স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে। তাই এ দিন না জেনেই স্কুলে পৌঁছে গিয়ে ফেরত আসতে দেখা গিয়েছে ছেলেমেয়ে-সহ বেশ কিছু অভিভাবককে। এই সার্বিক বিভ্রান্তির পরিবেশও ভোটের হার কম রাখার অন্যতম কারণ বলে স্থানীয় বাসিন্দা এবং প্রশাসনিক মহলের একাংশের ধারণা।

কেউ কেউ যদিও বলছেন, পুনর্নির্বাচনের খবর বেশি মানুষের কাছে যাতে না পৌঁছয়, তার জন্য তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের তৎপরতাও ছিল! উপর থেকে অবশ্য নির্দেশ ছিল ‘সুষ্ঠু ভাবে ভোট হবে’ বলে মানুষের কাছে আশ্বাস দেওয়ার। মৌখিক ভাবেও সেই নির্দেশ পালন করার কথা বলেছেন শাসক দলের স্থানীয় নেতারা। কিন্তু সল্টলেকে পুনর্নির্বাচনের হাল-হকিকত ঘুরে দেখতে গিয়ে এ দিন জানা গেল, কিছু বাসিন্দা পুনর্নির্বাচনের আগের রাতে ভোটার স্লিপ পেয়েছেন। অনেকেই আবার পাননি! বিরোধীদের একাংশের অভিযোগ, সচেতন ভাবেই সেই সব বাড়িতে ভোটার স্লিপ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, যাঁদের ভোট শাসকের বাক্সে পড়ারই নিশ্চয়তা বেশি। কমিশনের সিদ্ধান্তকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে পুনর্নির্বাচনে এ বার অংশই নেয়নি তিন বিরোধী পক্ষ বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও বিজেপি। ফলে, তাদের দিক থেকে পুনর্নির্বাচনের জন্য উচ্চকিত কোনও প্রচারও ছিল না। তার ফায়দা শাসক দল নিজের মতো করেই নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

বিধাননগরেরই বাসিন্দা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, ‘‘যে সব বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটায় তৃণমূলের স্বাভাবিক ভাবেই জেতার পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু ৩ তারিখ তারা মানুষকে ভোট দিতেই দেয়নি। তৃণমূলের ওই কাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই মানুষ আজ আর ভোট দিতে চাননি।’’ তৃণমূলের এক বিধায়ক আবার পাল্টা বলছেন, ‘‘এতে তো আমাদেরই সুবিধে! বেশি সংখ্যক মানুষ বুথে গিয়ে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এলে বরং আমরা বেশি অসুবিধেয় পড়তাম!’’

বিধাননগরের বুথগুলির মধ্যে তুলনায় বেশি ভোট পড়েছে ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডের মধ্যে বিধাননগর রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয় (বিডি স্কুল)-এর বুথেই যেমন ভোট পড়েছে ৪৭.০৯%। ওই ওয়ার্ডের নির্দল প্রার্থী অনুপম দত্ত আগের দিন থেকেই বাড়ি বাড়ি অনুরোধ জানিয়ে এসেছিলেন, পুনর্নির্বাচনে সকলে মিলে যেন তাঁর পক্ষে দাঁড়ান। একটা বুথের রায়ে ফলাফল হয়তো ওল্টাবে না। কিন্তু পুনর্নির্বাচনে একটা বুথের তথ্য দিয়েই বোঝানো যেতে পারে, স্বাভাবিক ভোট হলে ফল কী হতে পারত! তা ছাড়াও তৃণমূলের একটি সূত্রের ইঙ্গিত, ভোটের দিন ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে ব্যাপক গোলমালে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিরক্ত। কলকাতা পুরসভার কয়েক জন নির্দল কাউন্সিলরের মতো বিধাননগরেও অনুপমবাবু জিতলে তাঁকে তৃণমূলে ফিরিয়ে নেওয়া হতে পারে বলে সূত্রটির দাবি। বস্তুত, সেই ইঙ্গিত পেয়েই এ দিন অনুপমবাবু প্রকাশ্যে ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যের ছবিই তুলে ধরতে চেয়েছেন। যদিও পুনর্নির্বাচন শেষে অনিন্দ্য হাসতে হাসতে তাঁর কয়েক জন ঘনিষ্ঠকে বলেছেন, ‘‘আমি আমার কাজ হাসিল করে নিয়েছি!’’

কে কতটা কাজ হাসিল করলেন, তার উত্তর মিলবে আজ, শনিবারই। পুনর্নির্বাচন-সহ বিধাননগর, আসানসোল ও বালির সব বুথেরই গণনা হবে আজ। বিজেপি গোটা গণনাই বয়কট করেছে। আর রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে এ দিনের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু জানিয়েছেন, পুনর্নির্বাচনে যে সব বুথে তাঁরা ভোট বয়কট করেছেন, সেখানে গণনাতেও তাঁরা এজেন্ট রাখবেন না। তবে বাকি গণনা বামেরা বয়কট করছে না। বাম সূত্রের খবর, ভবিষ্যতে মামলা করার প্রস্তুতির জন্যই আজ গণনায় থাকতে বলা হয়েছে এজেন্টদের।

এই সংক্রান্ত আরও :

নিয়োগে অসন্তুষ্ট কোর্ট, তবে স্থগিত হচ্ছে না গণনা

ভোট দিয়ে, না দিয়েও প্রতিবাদ সল্টলেকে

মৃতেরাও দিব্যি ভোট দিয়েছেন বিধাননগরে

বাতিল পরীক্ষা, ভোগান্তি স্কুলে এসে

বয়কটেই জয় দেখছেন রমলা

ভোটচিত্রে ভোলবদল উঁচু তলার ইঙ্গিতেই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE