Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভোটারদের তাড়িয়ে ছাপ্পা দিল বহিরাগতরা

দিনটা কেমন যাবে, সকাল দেখে বোঝার উপায় মোটেই ছিল না। দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে ভোট শুরু হয়েছিল। আসানসোলের বিধানচন্দ্র ওরফে বিসি কলেজে ভোটারদের লম্বা লাইন। বাইরে সব দলের লোকই ইতিউতি ছড়িয়ে। কিন্তু খবর ছিল।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আসানসোলের কাল্লায় গুলিবিদ্ধ সুখলাল কর্মকার। শনিবার। ছবি: শৈলেন সরকার।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আসানসোলের কাল্লায় গুলিবিদ্ধ সুখলাল কর্মকার। শনিবার। ছবি: শৈলেন সরকার।

সুশান্ত বণিক
আসানসোল শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

দিনটা কেমন যাবে, সকাল দেখে বোঝার উপায় মোটেই ছিল না।

দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে ভোট শুরু হয়েছিল। আসানসোলের বিধানচন্দ্র ওরফে বিসি কলেজে ভোটারদের লম্বা লাইন। বাইরে সব দলের লোকই ইতিউতি ছড়িয়ে।

কিন্তু খবর ছিল।

‘ভোট করানো’র জন্য তৃণমূল যে বহিরাগতদের এনে জড়ো করেছে, তা শুক্রবারই এসবি গড়াই রো়ডে একটি ভাড়াবাড়িতে ঢুকে দেখা গিয়েছিল। বিসি কলেজ যে বুথ লুঠের নিশানায় রয়েছে, সেই খবরও কানে এসেছিল আগের রাতেই।

কলেজ চত্বরে ৭৬ নম্বর ওয়ার্ডের চারটে বুথ। ঢুকেই সামনে ৬৭৬, ৬৭৭, ৬৭৯। ভিতর দিকে, কিছুটা আড়ালে ৬৭৮। কলেজের গেটে মোতায়েন পুলিশ, ইএফআর। বাইরে দাঁড়িয়ে পুলিশভ্যানও। আপাত দৃষ্টিতে ভয়ের কোনও কারণ নেই।

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ৮টার দিকে ঝুঁকছে। বেশ হেলেদুলেই এগোচ্ছিল পুরুষ আর মহিলাদের লাইন। হঠাৎই গেটের বাইরে পরপর কয়েকটা বড় গাড়ি এসে থামে। লাফিয়ে নেমে হুড়মুড় করে বুথ চত্বরে ঢুকে পড়ে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট জন। পুলিশ-ইএফআর কেউই তাদের বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি।

ভোটারেরাও গোড়ায় ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। সবই অচেনা মুখ। কলেজে ঢুকেই কয়েক জন দৌড়ে ৬৭৭ নম্বর বুথের মুখে চলে যায়। সেখান থেকে চিৎকার করে বলতে থাকে— ‘‘আর কাউকে ভোট দিতে হবে না! অনেক হয়েছে। যান, বাড়ি চলে যান।’’ বাকিরাও চারপাশ থেকে তেড়ে আসে। লাইন ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার জন্য তর্জন-গর্জন শুরু হয়ে যায়। লোকগুলোর হাত খালি, কিন্তু বেশ কয়েক জনের কোমরে কিছু গোঁজা, জামা উঁচু হয়ে আছে।

আতঙ্কে বেশির ভাগ ভোটার চত্বর ছেড়ে পালাতে থাকেন। ছোটাছুটি শুরু করে দেন মহিলারা। কিন্তু কিছু লোক মরিয়া, ভোট দেবেনই। তেমনই এক জন, প্রবীণ ভোটার সুশান্ত বিশ্বাস লাইন না ছেড়ে বরং বুথের দিকেই কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। তুমুল গালিগালাজ করে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় দুষ্কৃতীরা। তাঁর পা কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। খোঁড়াতে-খোঁড়াতে তিনি কলেজ চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যান।

ইতিমধ্যে ৬৭৭ নম্বর বুথে ঢুকে পড়েছিল জনা দশ-বারো বহিরাগত। পিছু-পিছু ঢুকে সঙ্গী চিত্রগ্রাহক ক্যামেরা বের করতেই কয়েক জন তেড়ে ওঠে— ‘‘ক্যামেরা ভিতরে রাখুন! এ সব করে লাভ হবে না।’’ এক জন ছুটে গিয়ে ইভিএম ঢাকার চটের ত্রিপল ধরে টান মারে। দু’জন টান মেরে ফেলে দেয় ভোটকর্মীদের আনা কাগজপত্রের ব্যাগ।

সামনেই ছিলেন বিজেপির পোলিং এজেন্ট তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। এক জন তাঁকে সপাটে চড় কষিয়ে বলে, ‘‘বাইরে যা!’’ প্রায় কাঁপতে-কাঁপতে তিনি বেরিয়ে যান। ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী, যাটোর্ধ্ব কমলজিৎ সিংহ রুখে উঠে কিছু বলতে গিয়েছিলেন। তাঁর বয়সের তোয়াক্কা না করে দু’তিনটে থাপ্পড় কষিয়ে দেয় ষন্ডা মতো একটা লোক। মাটিতে পড়ে যান কমলজিৎ।

ইতিমধ্যে ইভিএমের সামনে একটি ছেলে চলে গিয়েছে। বুথের প্রিসাইডিং অফিসার হুমকির মুখে কাঁটা। ছাপ্পা ভোট দেওয়া চলতে থাকে। এ ভাবে মিনিট বিশেক চলার পরে, ৯টা নাগাদ বাইরে থেকে সিপিএম এবং কংগ্রেস কর্মীরা ছুটে আসতে থাকেন। হিরাপুর থানা থেকে বাড়তি পুলিশবাহিনী এসে পৌঁছয়। বিরোধীরা যখন তাদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, সবার সামনে দিয়ে বহিরাগতদের দল বেরিয়ে যায়।

সামনের তিনটে বুথের (ভিতরের দিকের ৬৭৮ নম্বর বুথের হদিস বে-এলাকার দুষ্কৃতীরা পায়নি) পোলিং এবং প্রিসাই়ডিং অফিসারেরা তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে। ৬৭৭ নম্বরের প্রিসাইডিং অফিসার চণ্ডীচরণ চট্টরাজ হতাশ গলায় বলেন, ‘‘তাণ্ডব চালিয়ে ওরা জাল ভোট দিয়ে গেল!’’ তাড়া খেয়ে পালিয়ে বুথ থেকে বেশ দূরে গাছের নীচে বসে হাঁফাচ্ছিলেন মালা দে। কাঁদোকাঁদো গলায় তিনি বললেন, ‘‘একে ভোট বলে? এ তো গুন্ডামি!’’

আসানসোল কর্পোরেশনের প্রথম ভোটে এই যদি শাসকদলের রিগিং করার একটা নমুনা হয়, আর এক নমুনা ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডে বার্নপুর বয়েজ হাইস্কুলের চারটি বুথ। যেখানে গেলে এমনিতে বোঝারই উপায় নেই যে আদৌ কোনও গণ্ডগোল আছে। কিন্তু দুপুর ১২টার পর থেকে সেখানে কী হারে ছাপ্পা চলেছে, একটু দাঁড়িয়ে দেখলেই তা পরিষ্কার।

ছবিটা এ রকম: গেটে নির্বিকার উর্দিধারী পুলিশ। বুথের বাইরে লম্বা লাইন। একেবারে সামনে জনা চল্লিশ লোক বুথ জ্যাম করে দাঁড়িয়ে। তারাই লাইন ধরে ভোট দিচ্ছে, আবার ফিরে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছে। তারা এতই বেপরোয়া যে ক্যামেরা তাক করতে দেখলেও ঘাবড়ায় না। বরং দেওয়ালের দিকে মুখ করে ভাসিয়ে দেয়— ‘‘লাভ নেই, লাভ নেই। কিচ্ছু ঝামেলা নেই।’’

পিছনে সাধারণ ভোটারেরা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে-থেকে অধৈর্য হয়ে ফিরে গিয়েছেন। দৈবাৎ কেউ বুথের ভিতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও লাভ নেই। যেমন দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ ৬৯৯ নম্বর বুথ থেকে বেরিয়ে ইস্কো কর্মী অনিল দাস ও তাঁর ছেলে বিশ্বজিৎ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘‘এই যে দেখুন, আমাদের ভোট দিতে দিল না। বলল, ভোট হয়ে গিয়েছে।’’

এর বাইরে, ধ্রুবডাঙায় বুথ দখল করতে গিয়ে এক তৃণমূল কর্মীর পাল্টা মার খাওয়া বা কাল্লায় বুথের সামনে এলোপাথাড়ি গুলিতে বিজেপির তিন জন জখম হওয়ার মতো নানা ঘটনা তো রইলই।

শনিবার দিনভর এ রকমই ভোট দেখল আসানসোল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE