Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মঞ্চের সঙ্গে ফাটল বাড়ল বরুণের পরিবারের

দূরত্বটা বাড়ছিল দু’তরফের। রবিবার বরুণ বিশ্বাসের স্মরণসভা ঘিরে ফাটল আরও স্পষ্ট হল নিহত শিক্ষকের পরিবার ও প্রতিবাদী মঞ্চের। ২০১২ সালের ৫ জুলাই গোবরডাঙা স্টেশনের সামনে দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হন কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশনের বাংলার শিক্ষক বরুণ।

বরুণের ছবি হাতে দিদি প্রমীলা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

বরুণের ছবি হাতে দিদি প্রমীলা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
গাইঘাটা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৫ ০০:৪১
Share: Save:

দূরত্বটা বাড়ছিল দু’তরফের। রবিবার বরুণ বিশ্বাসের স্মরণসভা ঘিরে ফাটল আরও স্পষ্ট হল নিহত শিক্ষকের পরিবার ও প্রতিবাদী মঞ্চের।

২০১২ সালের ৫ জুলাই গোবরডাঙা স্টেশনের সামনে দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হন কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশনের বাংলার শিক্ষক বরুণ। ২০০০ সাল নাগাদ গাইঘাটার সুটিয়ায় একের পর এক যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল, তার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন বরুণ। এলাকার দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করে প্রতিবাদী মঞ্চ গড়ে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের সামনের সারিতে ছিলেন বরুণ।

তিন বছর আগে তাঁর খুনের প্রতিবাদে গোটা এলাকা নেমে এসেছিল রাস্তায়, দেহ ছুঁয়ে শপথ নিয়ে সে দিন অনেকে চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছিলেন, ‘‘প্রতিবাদীর মৃত্যুতে প্রতিবাদ শেষ হয় না, দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লড়াই আমরা চালিয়ে যাব।’’ কিন্তু তিন বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল, বরুণের স্মরণসভায় হাতে গোনা কুড়ি-পঁচিশ জনের বেশি লোক। বরুণের পরিবারও যেখান থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখলেন।

রবিবার বরুণের বাড়ির কাছেই স্মরণসভার আয়োজন করেছিল সেই প্রতিবাদী মঞ্চ। মৃত্যুর প্রথম বর্ষপূর্তিতে বরুণের দিদি প্রমিলা রায়, বাবা জগদীশবাবু, তা গীতাঞ্জলিদেবী-সহ পরিবারের অনেকেই এসেছিলেন স্মরণসভায়। গত বছর তাঁরা আসেননি অনুষ্ঠানে। দূরত্ব বাড়ছিলই। এ বার সরাসরি দু’পক্ষ একে অন্যের সমালোচনায় নেমেছে।

এ দিন সকালে বরুণের বাড়ির পাশে যখন স্মরণসভা চলছে, তখন ঢিল ছোড়া দূরত্বে বরুণের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, যে ঘরটিতে বরুণ থাকতেন, সেই ঘরের খাটে বসে অঝোরে কেঁদে চলেছেন প্রমীলা। খাটের উপরে রাখা বরুণের কয়েকটি ছবি। পাশের টেবিলে রাখা ক্ষুদিরামের ছবি। বরুণের একটি ছবির সামনে দু’টি জবা ফুল রাখা। আর একটি ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে প্রমীলা বলেন, ‘‘ভাই জবা ফুল খুব ভালবাসত। তাই রোজ সকালে ওর ছবিতে জবা ফুল দিই।’’

প্রতিবাদী মঞ্চের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কেউ ডাকেনি। তবে ডাকলেও যেতাম না। কারণ ওঁরা চান না, ভাইয়ের প্রকৃত খুনিরা শাস্তি পাক।’’ মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দারদের বিরুদ্ধেও তাঁর বিষোদ্গার, ‘‘বরুণকে ভাঙিয়ে ওঁরা প্রচুর টাকা লুঠ করছেন। একটাও কাজ করেননি। আজকে মানুষকে দেখাতে নাটক করছেন স্মরণসভার নামে।’’

এ কথা শুনে স্বভাবতই ফুঁসে উঠলেন ননীগোপালবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘বরুণের পরিবারের আমাদের কাছে কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। কারণ বরুণকে সঙ্গে নিয়েই আমরা ওঁর আদর্শ, কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। পরিবারের কেউ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলে বরুণের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি স্মৃতি ফাউন্ডেশনে দান করতে হবে— সেই কারণেই ওঁরা আমাদের থেকে দূরত্ব তৈরি করেছেন।’’ একধাপ এগিয়ে মঞ্চের সম্পাদক পরিমল মণ্ডল এ-ও বলেন,‘‘ বরুণ মারা যাওয়ার পরে পরিবার আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছে।’’ যা শুনে প্রমীলাদেবীর পাল্টা মন্তব্য, ‘‘আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত হোক। তা হলেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে।’’

বরুণ খুনের পরে কয়েক জন ধরা পড়লেও খুনের তদন্তে অগ্রগতি নিয়ে খুশি নন পরিবার। খাদ্যমন্ত্রী তথা হাবরার তৃণমূল বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তাঁর ভাইকে খুনে মদত দিয়েছেন বলে কিছু দিন ধরেই সরাসরি নানা জায়গায় বক্তব্য রাখছেন বরুণের দিদি প্রমীলা রায়। যাকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে পরিবারের। ইতিমধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে সল্টলেক আদালতে মানহানির মামলা করেছেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু। আদালত প্রমিলাদেবীকে হাজিরার নির্দেশ দিয়েছে। তিনি হাজিরা না দেওয়ায় আবার গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। প্রমীলাদেবী এ দিনও বলেন, ‘‘ভাইয়ের মৃত্যুর সঙ্গে জ্যোতিপ্রিয়বাবু জড়িত, এ কথা আমার মৃত্যু হলেও আমি বলে যাব।’’

তৃণমূল শিবির প্রমিলাদেবীদের বিরুদ্ধে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ। বরুণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরাও এক সময়ে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বলে দাবি করে জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা আমরাও চাই। কিন্তু বরুণকে ভাঙিয়ে তাঁর বাবা-দিদি যে ভাবে ব্যবসা শুরু করেছেন, তা বন্ধ হওয়া উচিত।’’ ননীগোপালবাবুরা বরাবরই বলে আসছেন, জ্যোতিপ্রিয়বাবু বরুণকে খুনে মদত দিয়েছেন, এমন তথ্য তাঁদের হাতে নেই। যে ভাবে প্রমীলা বিষয়টি নিয়ে সরব হচ্ছেন, তা তাঁরা ভাল চোখে দেখেনন না, তা-ও নানা ভাবে বলেছেন ননীগোপালবাবুরা।

ইতিমধ্যে, প্রতিবাদী মঞ্চের অনেকের সঙ্গে তৃণমূল শিবিরের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে বলেও এলাকায় গুঞ্জন। ননীগোপালবাবুর দোকানের উপরের অংশ অফিস করেছে তৃণমূল।

ননীগোপাল বলেন, ‘‘বরুণের খুনে প্রকৃত অপরাধীরা সাজা পাক, সেটা আমরাও চাই। কিন্তু সে জন্য আইন-আদালত আছে। আমরা আন্দোলন জারি রেখেছি। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া দোষারোপ আমরা পছন্দ করছি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE