Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

মাওবাদীরাও ছিল নন্দীগ্রামে

হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল নিজেরই পুলিশ। বাম জমানার সেই নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তৃণমূল-মাওবাদী যোগসাজসের তত্ত্বকে কার্যত মান্যতা দিয়ে দিল্লিকে রিপোর্ট দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারেরই গোয়েন্দা বিভাগ। বিদায়ের আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার বারবার বলেছিল, নন্দীগ্রামে তৃণমূলের সঙ্গে রয়েছে মাওবাদীরা। পরে বিজেপির মুখেও একই নালিশ শোনা গিয়েছে।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৫১
Share: Save:

হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল নিজেরই পুলিশ। বাম জমানার সেই নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তৃণমূল-মাওবাদী যোগসাজসের তত্ত্বকে কার্যত মান্যতা দিয়ে দিল্লিকে রিপোর্ট দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারেরই গোয়েন্দা বিভাগ।

বিদায়ের আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার বারবার বলেছিল, নন্দীগ্রামে তৃণমূলের সঙ্গে রয়েছে মাওবাদীরা। পরে বিজেপির মুখেও একই নালিশ শোনা গিয়েছে। অন্য দিকে তৃণমূলনেত্রী থেকে শুরু করে দলের বড়-মাঝারি-ছোট দরের নেতারা বরাবর তা অস্বীকার করে এসেছেন। কিন্তু এ বার মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মমতারই অধীন রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তাতে সিপিএম-বিজেপির অভিযোগেই সিলমোহর পড়েছে। রিপোর্টের বক্তব্য: নন্দীগ্রাম আন্দোলনে মাওবাদীরা ছিল তৃণমূলের পাশে। এমনকী, সেখানে বিভিন্ন মাওবাদী গণসংগঠনের একাধিক নেতা-নেত্রীকে তৃণমূলের স্থানীয় নেতারাই আশ্রয় দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ‘ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কারপ্রাপ্ত মহাশ্বেতা দেবীকে এক মাওবাদী সংগঠনের নেত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে রিপোর্টে।

বিরোধী থাকাকালীন তৃণমূলনেত্রী অবশ্য জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের অস্তিত্বই মানতে চাননি। “ও সব মাওবাদী-ফাওবাদী বলে কিছু নেই।” তখন হামেশাই বলেছেন তিনি। তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল, এ রাজ্যের কোথাওই মাওবাদী নেই। আর সেই যুক্তিতে ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত জঙ্গলমহল থেকে আধা ফৌজ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এসেছিলেন মমতা, যা ধারাবাহিক ভাবে নস্যাৎ করে এসেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। গোয়েন্দা-তথ্য হাতে নিয়ে বুদ্ধবাবু তখন নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর-লালগড়-নেতাইয়ের অশান্তির নেপথ্যে ‘তৃণমূল-মাওবাদী আঁতাতের’ ভূমিকার দিকেই আঙুল তুলেছিলেন।

২০০৭-এর জানুয়ারিতে সালিম গোষ্ঠীর প্রস্তাবিত কেমিক্যাল হাব নির্মাণের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামবাসীর জমিরক্ষা আন্দোলনে তৃণমূল সামিল হয়। তৃণমূলের নেতৃত্বেই নন্দীগ্রাম প্রশাসনের হাতের বাইরে চলে যায়। রাস্তা কেটে, মেয়েদের সামনে দাঁড় করিয়ে পুলিশকে আটকানো হয়। শেষমেশ ওই বছরের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশি অভিযান চালায় সরকার। সে দিন পুলিশের গুলিতে ১৪ জন মারা যান। অনেকের মতে, ওটাই পশ্চিমবঙ্গে তিন দশকব্যাপী বাম শাসনের শেষের শুরু।

নন্দীগ্রামেও তৃণমূলের সঙ্গে মাওবাদীরা মিশে ছিল বলে তখন দাবি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। এখন তৃণমূল সরকারের গোয়েন্দা-উপদেষ্টা তথা আইজি ওমপ্রকাশ গুপ্তের দেওয়া রিপোর্টে কার্যত তারই প্রতিধ্বনি। রিপোর্ট বলছে, গণসংগঠনের আড়ালে মাওবাদীরা নন্দীগ্রাম আন্দোলনে জড়িয়েছিল। তাদের লোকজন স্থানীয় এমন কিছু নেতার বাড়িতে আশ্রয় নেয়, ঘটনাচক্রে যাঁরা বর্তমান শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ স্বরাষ্ট্র দফতরের হাত ঘুরে রিপোর্টটি পৌঁছে গিয়েছে দিল্লির নর্থ ব্লকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসে। ঠিক কী রয়েছে তাতে?

রিপোর্ট অনুযায়ী, জয়িতা দাস ও দেবলীনা চক্রবর্তী নামে দুই মাওবাদী নেত্রী নন্দীগ্রামে গিয়ে ‘মাতঙ্গিনী মহিলা সমিতি’ গড়ে তোলেন। তাঁরা ছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা নিশিকান্ত মণ্ডলের বাড়িতে, যিনি কিনা সে সময়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ।’ নিশিকান্ত পরে সোনাচূড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হন, এবং ২০১০-এ সোনাচূড়াতেই খুন হন। ২০০৭-০৮ সালে দেবলীনা-জয়িতাদের হাত ধরে বেশ কিছু মাওবাদী নন্দীগ্রামে ঢোকেন। রাজ্য গোয়েন্দাদের দাবি, মাওবাদী শাখা সংগঠন ‘ছাত্র-ছাত্রী সংহতি মঞ্চ’-এর নেতা অভিযান সরকারও নন্দীগ্রামে তৃণমূলের ছাতার তলায় ছিলেন দীর্ঘ দিন।

তবে আইজি-র রিপোর্টের বড় চমক, মহাশ্বেতা দেবীকে মাওবাদী শাখা সংগঠনের নেত্রীর তকমা। বলা হয়েছে, মাওবাদী শাখা সংগঠন ‘বন্দিমুক্তি কমিটি’র সভানেত্রী হলেন মহাশ্বেতা দেবী। সংগঠনটি ধৃত মাওবাদীদের তো বটেই, রাষ্ট্রবিরোধী সিমি-র কর্মীদেরও জেল থেকে ছাড়াতে চায়। কমিটির বিভিন্ন সদস্যের বিরুদ্ধে প্রশাসন কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, মোদী সরকারকে সে বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে।

নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন যিনি, অধুনা তমলুকের সেই তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য রিপোর্টের সত্যতা মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “এই আন্দোলন সম্পর্কে আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে বলে মনে হয় না। আমাদের আন্দোলনে কোনও মাও-ফাও ছিল না। নন্দীগ্রামবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে এ ভাবে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে।”

মহাশ্বেতা দেবীর পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, তিনি অসুস্থ, কথা বলার অবস্থায় নেই। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় রিপোর্ট প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি। যদিও রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, “যথেষ্ট প্রমাণ হাতে রেখেই রিপোর্টটি পাঠানো হয়েছে।”

কিন্তু আচমকা এমন একটা রিপোর্ট দিল্লিকে দেওয়া হল কেন?

মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের খবর: নরেন্দ্র মোদীর সরকার মাওবাদী গণসংগঠন সম্পর্কে তথ্যভাণ্ডার (ডেটাবেস) তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার জন্য গত ২১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নকশাল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দু’নম্বর অ্যান্টি নকশাল অপারেশন শাখা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে মাওবাদী শাখা সংগঠনগুলির তালিকা, কার্যকলাপ, সক্রিয় নেতা-কর্মীদের নাম, তহবিল সংগ্রহের পদ্ধতি এবং রাজ্য সরকারের তরফে গৃহীত ব্যবস্থাদি নিয়ে রিপোর্ট তলব করে।

সেই সূত্রেই রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগ ওই গোপন রিপোর্ট দিল্লিকে পাঠিয়েছে। রাজ্য পুলিশ এলাকায় সক্রিয় মাওবাদীদের ২৯টি শাখা সংগঠন ও তার ২৪ জন বাছাই নেতা-নেত্রী সম্পর্কে তাতে বিস্তারিত তথ্য মজুত। ওঁদের মধ্যে আছেন বন্দিমুক্তি কমিটির ছোটন দাস, ভানু সরকার, সুজাত ভদ্র, গণ প্রতিরোধ মঞ্চের রাংতা মুন্সি ও সুদীপ সেন, ইউএসডিএফের সৌম্য মণ্ডল ও রক্তিম ঘোষ, গণ প্রতিরোধ মঞ্চের পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সোমনাথ বেরা প্রমুখ।

রিপোর্ট বলছে, মাওবাদীদের হয়েই শাখা সংগঠনের সদস্যেরা প্রকাশ্যে অর্থ সংগ্রহ করেন। সাধারণ মানুষ ও সমমনস্কদের কাছ থেকে টাকা তুলে উঁচুস্তরে পাঠান। ২০১১-য় রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইস্তক অবশ্য মাওবাদী শাখা সংগঠনের কোনও নেতা-নেত্রীকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ-এলাকায় ধরা হয়নি।

প্রসঙ্গত, কলকাতায় মাওবাদীদের ৯টি গণসংগঠন সম্পর্কে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের যে বিশেষ রিপোর্ট, তাতেও রয়েছে নন্দীগ্রাম-যোগের উল্লেখ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

maoist nandigram jagannath chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE