Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মুখ্যমন্ত্রীর আড়ম্বরের সফরে প্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন

দেশের মাটিতে মুম্বই-দিল্লি-হলদিয়া। বিদেশ বলতে সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ-লন্ডন- ভুটান। গত সাড়ে চার বছরে পশ্চিমবঙ্গের জন্য লগ্নি টানতে এমন হরেক সফরে বেরিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভুটান-রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার পিটিআইয়ের ছবি।

ভুটান-রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার পিটিআইয়ের ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

দেশের মাটিতে মুম্বই-দিল্লি-হলদিয়া।

বিদেশ বলতে সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ-লন্ডন- ভুটান।

গত সাড়ে চার বছরে পশ্চিমবঙ্গের জন্য লগ্নি টানতে এমন হরেক সফরে বেরিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতায় হয়েছে একাধিক বাণিজ্য-সম্মেলন। তাতে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এত সবের পরেও নিশ্চিত বিনিয়োগের কোনও আগমনবার্তা নবান্নের কাছে নেই। বরং শিল্প-বাণিজ্য মহলের একাংশের পর্যবেক্ষণ হল, মমতা সরকারের শিল্প-বিরোধী জমি-নীতি ও বিশ্বে অবলুপ্তপ্রায় জমি ঊর্ধ্বসীমা আইন লগ্নি আকর্ষণের পথে বিরাট অন্তরায়। তার উপরে সিন্ডিকেট-রাজ ও লাগামছাড়া তোলাবাজির দুর্নাম। সব মিলিয়ে রাজ্যের শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলা থেকে ভিন রাজ্যে শিল্পের পাড়ি জমানোর পরম্পরা আরও গতি পেয়েছে।

তাতে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর সপার্ষদ দেশ-বিদেশ ঘোরার উৎসাহে ভাটা পডছে না। চার দিনের ভুটান সফর সেরে শুক্রবার তিনি কলকাতায় ফিরেছেন। ভুটানের রাজার আমন্ত্রণে তিনি গিয়েছিলেন। তাই একে সরকারি ভাবে ‘লগ্নিসফর’ তকমা দেওয়া যাবে না। তবু থিম্পুতে বাণিজ্য-প্রতিনিধিদের মমতা বৈঠক করেছেন। যদিও তার ফলাফল রাজ্যের আলু-ব্যবসার বহরবৃদ্ধি ও অন্ডালে ভুটানি বিমান নামানোতেই আটকে থেকেছে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন কলকাতায় পরমা উড়ালপুলের উদ্বোধন করে গর্বের সঙ্গে জানিয়েছেন, জানুয়ারিতে কলকাতায় বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে হাজির থাকবেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোগবে, বক্তৃতাও করবেন। যাকে শিল্পক্ষেত্রে বড় সাফল্য হিসেবেই দেখছেন তৃণমূলনেত্রী।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বিনিয়োগের আদর্শ পরিবেশ ও পরিকাঠামো তৈরিতে নজর না দিয়ে শুধু শিল্প সম্মেলন বা সফর করে লাভ কী? বিনিয়োগ টানার নামে এ ভাবে কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচের সার্থকতা নিয়েও সংশয় প্রকট। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, ‘‘এর আগেও উনি বিরাট দলবল নিয়ে সিঙ্গাপুর, লন্ডন গিয়েছিলেন। বাংলার জন্য কী আনতে পারলেন, সেটা বলছেন না কেন?’’

বস্তুত শুধু বিরোধী নয়, শিল্পমহলের বড় অংশের কাছেও ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না। এই মহলের অভিমত, নিজের ঘর না-গুছিয়ে দেশ-বিদেশে ঘোরাটা অনর্থক। বিনিয়োগ টানতে হলে লগ্নির ক্ষেত্রগুলোকে ‘কনে সাজানো’-র মতো করে উপস্থাপিত করা জরুরি। যেমনটি করেছে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্নাটক।.এমনকী, নতুন রাজ্য তেলঙ্গানাও। অথচ সেই নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ প্রায় নজরেই আসছে না!

পরিণাম যা হওয়ার তা-ই। বিস্তর সম্ভাবনা সত্ত্বেও তৃণমূল আমলে এখানে বড় বিনিয়োগ কার্যত আসেনি। পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোয়ন্নয়ন নিগমের হাতে থাকা শিল্প-পার্কগুলোয় প্রচুর জমি পড়ে থাকলেও নেওয়ার লোক নেই! মালদহ, হলদিয়ার শিল্প-পার্কে জমির দাম কমিয়েও গ্রহিতা মিলছে না।

তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম দু’বছর কলকাতা ও হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’ নামে শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। রাজ্যের বাইরের বিশেষ কোনও নামী শিল্পপতি বা সংস্থা তাতে যোগ দেননি। লগ্নির তেমন আশ্বাসও মেলেনি। ২০১৩-য় রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী পাড়ি জমিয়েছিলেন মুম্বইয়ে। সেখানে আয়োজিত ‘রোড শো’-এ রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর কর্ণধার মুকেশ অম্বানি এসেছিলেন, মমতার সঙ্গে তাঁদের আলাদা বৈঠক হয়। নবান্নের খবর: বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে রিলায়্যান্সের ফোর-জি লাইন পাতায় যাবতীয় বাধা দূর করা হবে।

এর বাইরে বিনিয়োগের কোনও ঘোষণা মুম্বই সম্মেলনে হয়নি। পরের বছর, ২০১৪-র অগস্টে মুখ্যমন্ত্রী পাঁচ দিনের সফরে যান সিঙ্গাপুর। সফরের দেড় দিন বাণিজ্য সংক্রান্ত আলোচনার জন্য বরাদ্দ ছিল। বাকি সময়টা কাটে চিড়িয়াখানা, জুরং পাখিরালয়, বন্দর ইত্যাদি দেখে, রামকৃষ্ণ মিশনে ঘুরে। সিঙ্গাপুরে ১৩টি ‘মউ’ সই হলেও প্রস্তাবিত বিনিয়োগের কোনও অঙ্ক সরকার ঘোষণা করেনি। উপরন্তু মউ-চুক্তির একটিও বাস্তবায়নের দাবি এখনও শোনা যায়নি। সিঙ্গাপুর সফরে এ-ও সিদ্ধান্ত হয়, রাজারহাটে সিঙ্গাপুর-ইন্ডিয়া বিজনেস সেন্টার গড়া হবে। সে দেশের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং ইউয়ের নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার হবে। রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম সিঙ্গাপুরে অফিস খুলবে। একটি পরিকল্পনাও দিনের আলো দেখেনি।

সিঙ্গাপুরপর্বের পরে বিশ্ববঙ্গ।

এ বছরের গোড়ায় সল্টলেক স্টেডিয়ামে আয়োজিত ওই শিল্প সম্মেলনে ৩০টি দেশ সামিল হয়েছে বলে সরকার দাবি করেছিল। সম্মেলন শেষে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাবের কথা জানিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। তবে দেখা যায়, এর ১ লক্ষ ১২ হাজার কোটি-ই আসার কথা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে, যার কোনওটাকেই ‘নতুন’ বলা যাবে না বলে নবান্নের খবর।

মুখ্যমন্ত্রীর ‘লগ্নিযাত্রা’ অবশ্য অব্যাহত। গত জুলাইয়ে তিনি দলবল নিয়ে লন্ডন গিয়েছিলেন। তাতে ২২টি চুক্তি হলেও সম্ভাব্য লগ্নির অঙ্ক নিয়ে শিল্প দফতরের কর্তারা অন্ধকারে। চুক্তিগুলি রূপায়ণের কাজ কতটা এগলো, সে সম্পর্কেও সরকারি কর্তাদের মুখে টুঁ শব্দটি নেই। এমতাবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর ভুটান ঘুরে এলেন, যা থেকে প্রাপ্তি বলতে আলু আর অন্ডাল।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর হেলদোল নেই। বরং আগামী শিল্প সম্মেলন সার্থক করতে তাঁর সেরা বাজি এখন তোগবে।

ভুটান যত ছোট দেশই হোক, উনি তার প্রধানমন্ত্রী তো বটে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE