Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মুখ্যমন্ত্রীর মান বাঁচিয়ে সাজিদকে ধরল পুলিশ

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মূল চক্রী সাজিদের নামে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। সেই পুরস্কারের অর্থ পেতে চলেছে বিধাননগর কমিশনারেটের একটি বিশেষ তদন্তকারী দল! ওই দলের অফিসারেরাই গ্রেফতার করেছেন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর বর্ধমান গোষ্ঠী বা মডিউলের চাঁই সাজিদকে। শনিবার দুপুরে কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে যশোর রোড থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৮
Share: Save:

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মূল চক্রী সাজিদের নামে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। সেই পুরস্কারের অর্থ পেতে চলেছে বিধাননগর কমিশনারেটের একটি বিশেষ তদন্তকারী দল! ওই দলের অফিসারেরাই গ্রেফতার করেছেন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর বর্ধমান গোষ্ঠী বা মডিউলের চাঁই সাজিদকে। শনিবার দুপুরে কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে যশোর রোড থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।

খাগড়াগড় কাণ্ডে প্রায় এক মাস ধরে তদন্ত করছে এনআইএ। একাধিক বার অভিযোগ উঠেছে, রাজ্যের পুলিশ ও গোয়েন্দারা তাদের সঙ্গে ঠিকমতো সহযোগিতা করছেন না। রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই এনআইএ-কে তদন্তভার দিয়েছিল কেন্দ্র। আইনত তাতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু এই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে প্রথম থেকেই বিরোধিতা করছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশের একাংশের অসহযোগিতার পিছনেও তারই ছাপ পড়েছিল বলে মনে করছেন অনেকেই। এই টক্করের আবহ শেষ পর্যন্ত লঘু করেছিলেন মমতা নিজেই। এক প্রকাশ্য সভা থেকে কেন্দ্রের প্রতি তাঁর বার্তা ছিল, “আগে তো একটু জানাতে হবে ভাই।” এর পরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল রাজ্যে এসে বৈঠক করেন মমতার সঙ্গে। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে ঘটনার গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন বলে প্রশাসন সূত্রে খবর। এর পর পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগও কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় এক নম্বরে থাকা সাজিদকে গ্রেফতার করল বিধাননগর কমিশনারেট। যে ঘটনার পরে রাজ্য পুলিশের একাংশের বক্তব্য, এক গোলে পিছিয়ে গেল এনআইএ!

কিন্তু সত্যিই কি তাই? এই প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনেরই আর একটি মহল থেকে। এই অংশের বক্তব্য, রাজ্য পুলিশ এবং এনআইএ এখন পরস্পরের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করেই কাজ চালাচ্ছে। এনআইএ-র একটি সূত্রেরও বক্তব্য, তাদের দেওয়া গোয়েন্দা-তথ্য ধরে এগিয়েই এই সাফল্য পেয়েছে বিধাননগর পুলিশ। ওই সূত্রের আরও দাবি, খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্তে নামা ইস্তক তারা বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আদানপ্রদান করছে। এই তালিকায় আছে কলকাতার স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ), বর্ধমান জেলা পুলিশ, সিআইডি ও বিধাননগর কমিশনারেট। তাই এই গ্রেফতারি যৌথ প্রচেষ্টারই ফল।

রাজ্য পুলিশ কিন্তু এ ভাবে বিষয়টি দেখতে নারাজ। রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, সূত্র বা তথ্য অনেককেই দেওয়া হয়। কিন্তু তা ধরে এগিয়ে যে সাফল্য পায়, তার কৃতিত্বকে কোনও ভাবেই খাটো করা যায় না। এই গ্রেফতারির পিছনে সব থেকে বড় মস্তিষ্ক যাঁর বলে মনে করা হচ্ছে, বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার সেই রাজীব কুমারও বলেন, “সাজিদকে গ্রেফতার করা আমাদের খুব বড় সাফল্য। কারণ, এনআইএ ওর মাথার দাম দশ লক্ষ টাকা ঘোষণা করেছিল। আমরা ওকে অনেক দিন ধরেই খুঁজছিলাম।” পুলিশ কমিশনার কিংবা ডিসি (সন্ত্রাস দমন শাখা) রণেন বন্দ্যোপাধ্যায়, গোয়েন্দাপ্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই ও সহকারী কমিশনার (সন্ত্রাস দমন শাখা) অনীশ সরকারের মতো কমিশনারেটের অন্য অফিসারেরাও এনআইএ-র কাছ থেকে সূত্র পাওয়ার ব্যাপারে কোনও কথা উচ্চারণ করেননি।

কী ভাবে খোঁজ মিলল সাজিদের?

বিধাননগর পুলিশ সূত্রের খবর, অষ্টমীর দুপুরে খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ হয়। সেই রাতেই গোয়েন্দারা আলাদা তদন্তে একটি গাড়ি পাচার চক্রের সন্ধান পান। তার সঙ্গে খাগড়াগড়ের কোনও যোগ আছে বলেও জানা ছিল না তখন। সেই সূত্র ধরেই পরে বাগুইআটির এক ক্যুরিয়র বা বাহকের সন্ধান মেলে। এই বাহকের কাজ ছিল বাংলাদেশিদের হাতে অবৈধ ভাবে টাকা পৌছে দেওয়া। তাকে জেরা করে আরও বেশ কিছু সূত্রের সন্ধান মেলে। ওই সূত্র ধরেই সপ্তাহ দুয়েক আগে জামশেদপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় গাড়ি পাচার চক্রের পাণ্ডা শিস মহম্মদ নামে এক ব্যক্তিকে। গোয়েন্দারা জানান, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, ওই ক্যুরিয়র জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) সদস্যদের হাতে অবৈধ ভাবে টাকা পৌঁছচ্ছে।

পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ সাজিদের কাছে এক লক্ষ টাকা পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল ওই বাহকের। পুলিশের দাবি, ওই ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এ দিন বিমানবন্দরের ওই এলাকায় যান গোয়েন্দারা। তাঁকে দিয়েই ডেকে পাঠানো হয় সাজিদকে। সাজিদ টাকা নিতে এলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এক গোয়েন্দা কর্তার বক্তব্য, “ওই বাহককে আগে ধরে ফেলাই ছিল আমাদের সাফল্যের প্রথম ধাপ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পরেই জানতে পারা যায় শনিবার টাকা পৌঁছে দেওয়ার কথা রয়েছে সাজিদের হাতে। আর তার পরেই কেল্লা ফতে।” যা শুনে এনআইএ-র এক অফিসারের জবাব, “এ রকম হাজার গোল খেতে রাজি। জিত তো আসলে সরকারেরই হল। সন্ত্রাসবাদীদের তো নয়।”

তাত্‌পর্যপূর্ণ ভাবে, এ দিন দুপুরেই নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান রাজীব কুমার। নবান্ন সূত্রের খবর, সাজিদকে গ্রেফতার করার খবরটি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতেই গিয়েছিলেন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ও পছন্দের পুলিশ অফিসারদের তালিকায় রাজীব কুমার কয়েক বছর ধরেই প্রথম সারিতে। যদিও বাম জমানায় তৃণমূলের শীর্ষ মহলের সঙ্গে তাঁর সমীকরণ মোটেই ভাল ছিল না। যে কারণে রাজ্যে পালাবদলের পরপর শোনা গিয়েছিল, তিনি ডিভিসি-তে যোগ দিতে পারেন। পরে অবশ্য দু’পক্ষের সম্পর্কের শীতলতা কেটে যায়। বিধাননগর কমিশনারেটের প্রথম পুলিশ কমিশনার হন রাজীব কুমার। এ দিন ১৯৮৯ ব্যাচের সেই আইপিএস অফিসারই মুখরক্ষা করলেন রাজ্য প্রশাসনের।

রাজ্য পুলিশকর্তাদের কয়েক জন তো বটেই, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) কোনও কোনও অফিসারও বলছেন, বর্ধমান জেলা পুলিশ, সিআইডি বা কলকাতার এসটিএফ ধরলে না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট তো সেই অর্থে তদন্তের কয়েকশো যোজনের মধ্যেও ছিল না। সে দিক থেকে এনআইএ-র কাছ থেকে সূত্র পেয়ে সাজিদকে গ্রেফতার করলেও বিধাননগর পুলিশের কৃতিত্ব কোনও ভাবেই খর্ব করা যায় না। তাঁদের কথায়, “এনআইএ-র কাছে যদি নির্ভুল ও সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকত, তা হলে তো তারাই সাজিদকে গ্রেফতার করতে পারত।” এমনই কেউ কেউ উদাহরণ দিয়ে জানিয়েছেন, বাংলাদেশি দুষ্কৃতী বা জঙ্গি পাকড়াও রাজীব কুমারের এই প্রথম নয়। এর আগে বাংলাদেশের দাউদ ইব্রাহিম বলে পরিচিত তনবিরুল ইসলাম ওরফে জয় এবং সুব্রত বায়েনকে গ্রেফতার করেন তিনি। সম্ভবত সেই সব যোগাযোগকে কাজে লাগিয়েই সাজিদকে ধরেছে বিধাননগর কমিশনারেট।

বুধবারই পৈলানে এক দলীয় কর্মিসভায় মমতা দাবি করেন, রাজ্য পুলিশ দক্ষ ও তারা যথেষ্ট ভাল কাজ করেছে। আর তার তিন দিনের মাথায় খাগড়াগড় কাণ্ডের প্রধান অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে সরকারের পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো জায়গায় এনে দিলেন বিধাননগরের পুলিশ অফিসারেরা। রাজ্য প্রশাসন সূত্রের বক্তব্য, এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে মমতা এর পরে দেখাতে চাইবেন, তাঁর পুলিশ এনআইএ-র থেকে বেশি দক্ষ। সেই সুর কিছুটা এ দিন শোনা গিয়েছে রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখে। তিনি বলেছেন, “রাজনৈতিক দৃষ্টিতে রাজ্য পুলিশকে দুর্বল বা অদক্ষ বলে ভেবেছিল কেউ কেউ। কিন্তু এই ঘটনা প্রমাণ করল, রাজ্য পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে এবং সমালোচনা সত্ত্বেও তাদের পারদর্শিতা এতটুকু কমেনি।”

বিরোধীরা অবশ্য এই দাবিতে কান দিতে নারাজ। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার ধাক্কা খেয়ে রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশ বাধ্য হয়েছে কাজ করতে।” আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, “এনআইএ এসে রাজ্য পুলিশকে সক্রিয় হতে বলেছে। মুখ্যমন্ত্রীকে বিপদ বোঝাতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে আসতে হয়েছে। তার পর পুলিশ সক্রিয় হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sajid police custody mamata khagragarh blast
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE