ব্যারাকপুরে ছবি তুলেছেন সজল চট্টোপাধ্যায়।
যা ভয় ছিল, তা-ই হল। বৃহস্পতিবার মৌসম ভবনের পূর্বাভাস জানিয়ে দিল, এ মরসুমে দেশে বর্ষা হবে স্বাভাবিকের চেয়ে কম।
প্রশান্ত মহাসাগরে জলতলের তাপমাত্রা যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এ বছর ‘এল নিনো’ সৃষ্টির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে গত মাসে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার একাধিক আবহ-বিজ্ঞান সংস্থা। তাদের এ-ও ধারণা, সম্ভাব্য এল নিনো ভারতীয় ভূখণ্ডে বর্ষার স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলবে। আগামী বর্ষার প্রথম পূর্বাভাস দিতে গিয়ে এ দিন মৌসম ভবনও জানিয়েছে, এ বার দেশে বর্ষার বৃষ্টির পরিমাণ হবে ৯৫%।
প্রসঙ্গত, ১৯৫০ থেকে ২০০০ সালএই পঞ্চাশ বছরে দেশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের যে পরিমাণ (৮৯ সেন্টিমিটার), তাকেই এ ক্ষেত্রে গড় স্বাভাবিক ধরা হচ্ছে। কোনও বছরে বৃষ্টি এর ৯৬%-১০৪% থাকলে তাকে স্বাভাবিক ধরা হয়। তাই ৯৫% মানে গড় স্বাভাবিকের তুলনায় কম। আর সত্যি তা-ই হলে দেশের অর্থনীতির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো আরও কঠিন হবে। এমনকী, বিপুল প্রত্যাশার রথে চড়ে নরেন্দ্র মোদী যদি দিল্লি দখল করতে পারেন, তাঁর পক্ষেও এই সঙ্কট সামাল দেওয়া দস্তুরমতো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
তবে পূর্বাভাস সার্থক করে বর্ষায় ঘাটতি যদি হয়ও, তার দায় এল নিনোর ঘাড়ে চাপাতে মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীরা এখনই রাজি নন। ওঁদের যুক্তি, লাতিন আমেরিকার পেরু উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের জলের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলেও এল নিনো যখন সক্রিয় হবে, তত দিনে ভারতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এমনিতেই কমজোরি হয়ে পড়ার কথা। যদিও প্রশান্ত মহাসাগরে জলের তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির দিকে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে বলে এ দিন জানিয়েছে মৌসম ভবন।
২০০৯-এ খরার পরে গত চার বছর দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণে সামঞ্জস্য না-থাকলেও গত বছর সারা দেশে বর্ষা ছিল মোটের উপর স্বাভাবিক। পরিণামে খাদ্য উৎপাদনও লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়েছিল। কিন্তু এ বার জানুয়ারি ইস্তক আবহাওয়ার রকম-সকম বেশ অস্বাভাবিক। কোথাও অনাবৃষ্টি, কোথাও বা অকাল বৃষ্টিতে ইতিমধ্যে ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
এমতাবস্থায় মৌসম ভবনের বর্ষা-পূর্বাভাসের উপরে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক নজর রেখেছিল। মন্ত্রকের এক সূত্রের কথায়, “অসময়ের বৃষ্টিতে এ বার পঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশে চাষবাসের ক্ষতি হয়েছে। অন্য দিকে অনাবৃষ্টিতে মার খেয়েছে মহারাষ্ট্রের কৃষি উৎপাদন। তবে দেশের প্রধান চাষগুলো যে হেতু বর্ষার বৃষ্টির উপরেই নির্ভরশীল, তাই মৌসম ভবনের পূর্বাভাসের দিকে আমরা সাগ্রহে তাকিয়ে ছিলাম।” এবং এ দিনের পূর্বাভাস ওঁদের কিছুটা নিরাশই করেছে। স্বাভাবিকের কম বৃষ্টি হলে কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও শুরু করেছে দিল্লি।
শুধু কৃষি মন্ত্রক নয়। মৌসম ভবনের বর্ষা-বার্তার দিকে উদ্গ্রীব নজর থাকে অর্থ মন্ত্রকেরও। এমনকী ৭ রেসকোর্স রোডের বাসিন্দারও। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন বিশ্বজোড়া মন্দার ধাক্কা সামাল দিতে একটা সময় ভাল বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে বৃষ্টির ভরসায় থেকেছেন পরবর্তী অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। এমনকী আলু, পেঁয়াজ-সহ আনাজপাতির দর যখন মাত্রাছাড়া, তখন খোদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের দফতরও আশা প্রকাশ করেছিল যে, ভাল বৃষ্টি হলেই সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে।
তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে, মোদী যদি শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেনও, এই পূর্বাভাস তাঁর সামনে বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে না তো? কারণ তখতে যিনিই বসুন, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাই হবে তাঁর প্রথম বড় পরীক্ষা। সে অবস্থায় বৃষ্টির আকালে চাষ মার খেলে আর্থিক বৃদ্ধির গতি আরও ঢিমে হবে সন্দেহ নেই। গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। মাথার তেল হোক বা শ্যাম্পুর স্যাসে চাহিদা বাড়বে না কিছুরই। ধাক্কা খাবে শিল্প। শুধু তা-ই নয়। চড়া মূল্যবৃদ্ধির কারণেই শিল্পমহল বারবার বলা সত্ত্বেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দীর্ঘ দিন যাবৎ সুদ কমাচ্ছে না। বৃষ্টি কম হলে শাক-সব্জির দাম বাড়বে, ক্ষীণতর হবে সুদ কমার সম্ভাবনা। শিল্প পড়বে আরও সঙ্কটে।
এমন বিবিধ সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে কৃষি-অর্থ-শিল্পমহলের একাংশের ধারণা, মৌসম ভবনের এ দিনের পূর্বাভাস মনমোহনের উত্তরসূরির কপালে দুশ্চিন্তার রেখা আঁকতেই পারে। মূল্যায়ন সংস্থা ক্রিসিলের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ডি কে জোসীর অবশ্য দাবি, “এই পূর্বাভাস নিশ্চয়ই উদ্বেগের। কিন্তু তা বলে আতঙ্ক ছড়ানোর কারণ নেই। কারণ, স্বাভাবিক বৃষ্টির সম্ভাবনা এখনও যথেষ্ট।”
মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে বর্ষা ঢোকার স্বাভাবিক সময় ১ জুন। তার সপ্তাহ দুয়েক আগে বর্ষা কড়া নাড়তে শুরু করে আন্দামান সাগরে। স্বাভাবিক নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা-প্রবেশ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মৌসম ভবনের দাবি: পয়লা জুন থেকে মাঝ জুলাই এই দেড় মাসের মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরে এল নিনো সক্রিয় হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ফলে এ দেশে বর্ষার আগমনের উপরে এল নিনোর ছায়া পড়ার আশঙ্কাও তারা এই মুহূর্তে দেখছে না।
মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীরা বর্ষার দ্বিতীয় পূর্বাভাসটি দেবেন জুন মাসে। ভারতের বর্ষাকে এল নিনো আদৌ প্রভাবিত করবে কিনা, এবং করলেও কতটা করবে, দ্বিতীয় পূর্বাভাসে তা পরিষ্কার হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy