Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আক্রান্ত তৃণমূল সদস্যা, হামলা বিজেপি-র উপরেও

রাতভর বোমাগুলি, ফের উত্তপ্ত পাড়ুইয়ের গ্রাম

রাজ্যে পুরভোটের পর নতুন করে এলাকা দখলের লড়াইয়ের জেরে কিছুদিন ধরেই সরগরম ছিল পাড়ুই। সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত তারই আগুন ছড়াল পাড়ুই এলাকায়। রাতভর তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে বোমা ও গুলির লড়াইয়ে তেতে উঠল এলাকা। শাসক দলের অভিযোগ, তারই জেরে পাড়ুই থানার স্থানীয় মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের এক তৃণমূলের সদস্যা এবং তাঁর স্বামীকে খুনের চেষ্টা করে বিজেপি।

হামলায় তছনছ ঘর। মঙ্গলবার পাড়ুই এলাকায় ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

হামলায় তছনছ ঘর। মঙ্গলবার পাড়ুই এলাকায় ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

নিজস্ব সংবাদদাতা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৫ ০৩:৫৫
Share: Save:

রাজ্যে পুরভোটের পর নতুন করে এলাকা দখলের লড়াইয়ের জেরে কিছুদিন ধরেই সরগরম ছিল পাড়ুই। সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত তারই আগুন ছড়াল পাড়ুই এলাকায়। রাতভর তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে বোমা ও গুলির লড়াইয়ে তেতে উঠল এলাকা।

শাসক দলের অভিযোগ, তারই জেরে পাড়ুই থানার স্থানীয় মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের এক তৃণমূলের সদস্যা এবং তাঁর স্বামীকে খুনের চেষ্টা করে বিজেপি। বিজেপির পাল্টা দাবি, আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের একাধিক কর্মী-সমর্থকও।

পুলিশ ও স্থানীয়দের দাবি, গত রাতে উভয় পক্ষের কর্মী-সমর্থক এবং বহিরাগত দুষ্কৃতীরা গুলি বোমা লড়াইয়ে নামে। কখনও বেলপাতা, কখনও ছাতারবাঁদিতে বোমা-গুলির লড়াই চলে। একসময় সংঘর্ষ ছড়ায় পাশের গ্রামগুলিতেও। ছাতারবাঁদি এলাকায় স্থানীয় মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য মহুবা বিবির বাড়ি। তাঁর স্বামী শেখ এনামুল গ্রাম কমিটির সভাপতি। মঙ্গলবার স্থানীয় বাসিন্দা তথা তাঁর দাদা গোলাম মুস্তফা বলেন, ‘‘আমার ভাই শেখ এনামুল এবং তার স্ত্রী মহুবা বিবিকে বোমা মারা হয়েছে। বাড়িতে লুটপাট এবং বোমাবাজি করেছে। দু’জনকেই সংকটজনক অবস্থায়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, স্থানীয় বাসিন্দা শেখ আজমল নেতৃত্বে বিজেপির কর্মী-সমর্থক এবং আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তৃণমূলের অপর আক্রমণ করেছে। সোমবার রাতের ওই ঘটনায়, গুরুতর জখম তৃণমূলের সদস্য মহুবা বিবি ও তার স্বামী গ্রাম কমিটি সভাপতি শেখ এনামুলকে সংকটজনক অবস্থায়ে সিউড়ি সদর হাসপাতালে এবং বর্ধমানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলেন, ‘‘বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব করছে, আমাদের কর্মীদের উপর বোমা নিয়ে হামলা করা করছে। পঞ্চায়েত সদস্য ও তাঁর স্বামী জখম হয়েছেন।’’

বিজেপির অবশ্য পাল্টা দাবি, তৃণমূলের মাখড়ার শেখ পেন্টার, শেখ মোশারফ, শেখ জাহির ও পালু বাউরির নেতৃত্বে বহিরাগতেরা গ্রামে বিজেপি পরিবার বেছে বেছে হামলা করেছে। বাসিন্দারা রুখে দাঁড়ানোয় তারা পালিয়ে যায়। যদিও এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় কোনও পক্ষ থেকে অভিযোগ জানানো হয়নি পাড়ুই থানায়। বিজেপির জেলা আহ্বায়ক অজুর্ন সাহা বলেন, ‘‘তৃণমূল গাড়ি করে বহিরাগত দুষ্কৃতী এনে গ্রাম দখলের লড়াইয়ে নেমেছে। জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল হাঁসড়ার মসজিদ মাঠে প্রকাশ্য জনসভায় যে কথা বলেছিলেন ‘যে কোনও মূল্যে লোক ঢুকিয়ে দেব’, তাতেই উত্তেজনা আরও ছড়াচ্ছে। বোমা বন্দুক নিয়ে বিজেপি কোনও দিন রাজনীতি করেনি। এটা তৃণমূলের সংস্কৃতি।’’

এ দিন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গুলির শতাধিক খোল ও বোমার সুতলি পড়ে রয়েছে। মঙ্গলবার সকাল গোরাপাড়া, হাঁসড়া মোড়, বেলপাতা, ছাতারবাঁন্দি, খেরাই এলাকা ছিল থমথমে। সকাল থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী এলাকায় গিয়ে কার্যত চিরুনি তল্লাশিতে নামে। বেলপাতা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল বিজেপি কর্মী আব্দুর রকিবের বাড়ির পাশের দেওয়ালে বোমার চিহ্ন স্পষ্ট। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রয়েছে সুতলি, বোমার টুকরো। রকিবের মা রাফিয়া বিবি বলেন, “আমার ছেলে গোবেচারা। বিজেপি করার অপরাধে ছ’ মাস হল জেল খাটছে। ছোট ছেলে আব্দুর সালেমকে দিন কয়েক আগে মেরে হাত পা ভেঙে দিয়েছে তৃণমূল। বর্ধমানে ভর্তি আছে। বাড়িতে কেউ পুরুষ মানুষ নেই।’’

বেলপাতা গ্রামেরই মুসলিম পাড়ায় তৃণমূল সমর্থকদের বাড়ি। মুসলিম পাড়া লাগোয়া কবরস্থানের পাশে শুকনো পুকুরের দু’পাড়ে পড়ে রয়েছে কয়েক শো গুলির খোল। বোমার টুকরো, সুতলি। তৃণমূলের সমর্থক ওই গ্রামের বাসিন্দা শেখ হারুনের অভিযোগ, ‘‘বিজেপি এবং তাদের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা মাখড়া এবং চৌমণ্ডলপুর থেকে লোকজন জোর করে বেলপাতা গ্রাম দখল করে লুঠপাট করতে এসেছিল। স্থানীয়রা রুখে দেওয়ায় তারা ফিরে যায়।’’ গ্রামের মাধ্যমিক পড়ুয়া শেখ মিরাজুল, রেজিনা খাতুন, খাদিজা খাতুন এবং উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ শেখ মফিজুল শেখ মইনুলরা জানান, সন্ত্রাসের মধ্যেও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম বলে জেলা পুলিশ পুরষ্কার দিল। কিন্তু জেলা পুলিশ সুপার আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে না কেন?

ঘটনাচক্রে এ দিনই পাড়ুই থানার ওসি অমরজিৎ বিশ্বাসকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় দায়িত্ব নিয়েছেন দুবরাজপুরের ওসি নীলোৎপল মিশ্র। বিরোধীদের দাবি, অমরজিৎ শাসক দলকে সন্তুষ্ট করতে পারছিলেন না। পাশাপাশি এলাকায় নতুন করে অশান্তি ছড়ানোয় অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারও। এ দিন অবশ্য ওসি বদল প্রসঙ্গে মুকেশ কুমারের সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘‘ওটা বিভাগীয় বিষয়।’’

ওসি বদল নিয়ে অনুব্রত বলেন, ‘‘ওই এলাকায় পুলিশ কাজ করছে। এসপি যা ভাল বুঝেছেন তাই করেছেন।’’

অন্যদিকে ইলামবাজারের পর এ বার বোলপুরের বাহিরী-পাঁচশোয়া পঞ্চায়েতের পাঁচশোয়া এলাকায় শাসকদলের দলীয় কার্যালয়ে আগুন ধরানোর অভিযোগ উঠল বিজেপি এবং তাঁদের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। শুধু দলীয় কার্যালয়ে আগুন দেওয়াই নয় তৃণমূলের অভিযোগ, তাদের পঞ্চায়েত সদস্যা-সহ একাধিক ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে শাসানি দেওয়া, এক সমর্থককে মারধর করারও অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। যদিও এ নিয়ে কোনও লিখিত অভিযোগ জানায়নি তৃণমূল।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার গভীর রাতে এলাকার কয়েক জন দুষ্কৃতী পাঁচশোয়ার তৃণমূল সদস্যা রানু দাসের বাড়িতে ঢুকে তাকে শাসানি দেয়। জব কার্ড এবং পোস্ট অফিসের বই কোথায় জানতে চেয়ে, ভয় দেখায়। তারা দলীয় কার্যালয়ে ঢুকে আসবাব ভাঙচুর চালায় এবং তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রানু দাসের অভিযোগ, ‘‘রাতে বাড়িতে ঘুমিয়েছিলাম। ওই সময়ে কয়েক জন বাইরে থেকে ডাকে। কে জানতে চাওয়ায়, অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালজ করে। দরজা খোলার পর ওরা জব কার্ড এবং পোস্ট অফিসের পাশ বই কোথায় জানতে চেয়ে শাসানি দেয়।’’

স্থানীয় বাসিন্দা তথা তৃণমূলের কর্মী সুনীল ঘোষেরও অভিযোগ, ‘‘এলাকার বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরা গ্রামের বিকাশ নন্দী, অধর মণ্ডলের বাড়িতে ঢুকে চড়াও হয়। মনোরঞ্জন মণ্ডলকে মারধর করেছে। বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করেছি।’’ তার দাবি, দলীয় কার্যালয়ে থাকা দুটি মোটর, ফ্যান, জরুরী কাগজপত্র নিয়ে পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। তৃণমূলের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করেছে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপির সহ-সভাপতি দিলিপ কুমার ঘোষ বলেন, “সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ। আসলে তৃণমূল এবং তাদের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা গরিব আদিবাসী মানুষদের টাকা পয়সা জোর করে কেড়ে নিচ্ছিল। জোর জুলুম করে তোলা তুলছিল। ওরা প্রতিবাদ করায়, এখন মিথ্যে অভিযোগ ফাঁদছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE