অভিযুক্তরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ বলছে, তারা পলাতক। চোখের সামনে এমন ঘটতে দেখে ক্ষুব্ধ ঘুঘড়াগাছি। জমি মাফিয়াদের গুলিতে গ্রামের বধূ অপর্ণা বাগের (৩৭) মৃত্যুর এক মাস পূর্তির দিনে গ্রামবাসীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ১২ জন অভিযুক্তের ১০ জনকেই কেন আজও ধরতে পারল না পুলিশ? কেন মৃতের পরিবারের এক জনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি? কেন গুলিবিদ্ধেরা আদালতে জবানবন্দি দিতে চাইলেও পুলিশ তার ব্যবস্থা করছে না?
বিরোধীদের অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা শাসক দলের আশ্রিত বলেই পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তা। জেলা কংগ্রেসের সভাপতি অসীম সাহা বলেন, “এই ঘটনায় প্রথম থেকেই তৃণমূল নেতাদের নাম উঠে আসছে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়ার ভয়ে পুলিশ যথাযথ তদন্ত করছে না।” জেলা বিজেপির মুখপাত্র সৈকত সরকারের দাবি, তৃণমূল নেতাদের আড়াল করতে পুলিশ এফআইআর থেকে বেশ কিছু নাম বাদ দিয়েছে। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তথা আইনজীবী সামশুল ইসলাম মোল্লা জানিয়েছেন, তাঁরা সিআইডি তদন্ত দাবি করবেন।
নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষের অবশ্য দাবি, অভিজ্ঞ অফিসারদের নিয়ে তৈরি বিশেষ তদন্তকারী দল দ্রুত বাকি অভিযুক্তদের ধরে ফেলবে। ধৃত লঙ্কেশ্বর ঘোষ (লঙ্কা) এবং পলাশ ঘোষকে জেরা করে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে বলেও দাবি তাঁর। তবে গ্রামবাসীরা এই আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না। তাঁদের কথায়, “লঙ্কা তৃণমূলের প্রশ্রয়েই এই এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। তার বিরুদ্ধে পুলিশ আবার কী ব্যবস্থা নেবে?”
লঙ্কার দাপট কতখানি, তা স্পষ্ট হয়েছিল গত ২৩ নভেম্বর। সে দিন নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছি গ্রামে ২২ বিঘা জমি দখল করতে আসে দুষ্কৃতীদের একটি দল। ফসল-ভরা জমির উপর দিয়ে নির্বিচারে ট্রাক্টর চালায় তারা। গ্রামের মহিলারা বাধা দিতে এলে তাদের উপর বোমা-গুলি বর্ষণ করে। বুকে গুলি লেগে মাঠেই লুটিয়ে পড়েন অপর্ণা। গুলিবিদ্ধ হ’ন এক ছাত্র এবং আরও দুই মহিলা। ঘটনার পর দিন পুলিশ লঙ্কাকে গ্রেফতার করে। লঙ্কা ধরা পড়ার পর নিজেকে তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করে। কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরীর সাফাই ছিল, “লঙ্কাকে চিনি। তবে লঙ্কা গরু পাচারকারী, সমাজবিরোধী। তাকে দলের কাছাকাছি ঘেঁষতে দিইনি।”
জেলা পুলিশ সূত্রেই অবশ্য জানা যাচ্ছে, সে দিনের ঘটনার পিছনে প্রভাবশালীদের থাকার সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়েছে তদন্তে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনার ন’দিন আগে, ১৪ নভেম্বর লঙ্কার ব্যাঙ্ক অ্যকাউন্টে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা জমা পড়েছিল। ঘটনার আগের দিন, ২২ নভেম্বর সেই অ্যাকাউন্ট থেকে তিন দফায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা তুলে নেওয়াও হয়েছিল। লঙ্কার দাবি, সে বাড়ি তৈরির কাজের জন্যই ২২ নভেম্বর টাকা তুলেছিল। কিন্তু এক পুলিশকর্তার দাবি, হামলা চালাতে বাইরের দুষ্কৃতীদের ভাড়া করেছিল লঙ্কা। বোমা-গুলি বাবদও খরচ হয়েছিল। সেই খরচ মেটাতেই ঘটনার আগের দিন লঙ্কা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলেছিল।
ঘটনার দিন যে ট্রাক্টর নিয়ে হামলা করে দুষ্কৃতীরা, তারও সন্ধান মিলিছে। দুর্গাপুরের বাসিন্দা দুই ভাইয়ের ট্রাক্টর লঙ্কাই ভাড়া নিয়েছিল বলেও জানতে পেরেছে পুলিশ। ওই ট্রাক্টর দু’টি পুলিশ আটক করেছে, মালিকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
কিন্তু গ্রামবাসীর একটি বড় অংশের ধারণা, লঙ্কা সামনে থাকলেও কৃষ্ণগঞ্জ কাণ্ডের আসল অপরাধীরা রয়ে গিয়েছে আড়ালে। শাসকদলের প্রভাবশালীদের আড়াল করতেই নিহত অপর্ণার মেয়ে নীলিমা বাগ, গুলিবিদ্ধ শ্যামলী তরফদার ও অন্যান্যরা ১৬৪ ধারায় গোপন জবানবন্দি দেওয়ার আগ্রহ জানালেও, পুলিশ তার ব্যবস্থা করছে না। সেই সঙ্গে, এক মাস পরেও নেপাল ঘোষ, বাসু ঘোষ, রাজকুমার ঘোষ, পরেশ ঘোষের মতো অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়নি বলে চাপ বাড়ছে গ্রামবাসীদের উপর।
নদিয়া জেলা তৃণমূলের সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত অবশ্য পুলিশের তদন্তে কোনও গাফিলতি দেখছেন না। তিনি বলেন, “ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মূল আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্তত তপন-সুকুরের মতো ঘটনা ঘটেনি। বিরোধী দল ও সংবাদমাধ্যম যাই অভিযোগ করুক, সামনের উপ-নির্বাচনে মানুষই তার জবাব দেবে।”
ঘুঘড়াগাছির মানুষ কিন্তু ফুঁসছে। গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা বিজয় মণ্ডল বলছেন, “পুলিশের তদন্তের বহর দেখে আমরা আর ভরসা রাখতে পারছি না। রাজনীতি নয়, আমরা চাই এই ঘটনার প্রকৃত বিচার হোক। দোষীরা শাস্তি পাক। প্রয়োজনে আমরা গ্রামের লোকজন এককাট্টা হয়েই আন্দোলনে নামব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy