Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শাস্তি চাই, হোম নিয়ে মুখ খুলছে হিলি

হোমে কিশোরীদের উপরে নির্যাতনের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। হিলির দুঃস্থ কিশোরীদের হোমের কর্ণধার দিলীপ মহন্তের প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, রাত হলেই কালো কাচে ঘেরা একটি ছোট গাড়ি করে হোমের মেয়েদের বালুরঘাটের শিবতলির মালোপাড়া এলাকার দিলীপবাবুর বাড়িতে আনা হত।

উৎকণ্ঠা নিয়ে হোমে অভিভাবকেরা। ছবি: অমিত মোহান্ত।

উৎকণ্ঠা নিয়ে হোমে অভিভাবকেরা। ছবি: অমিত মোহান্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
তিওড় (হিলি) শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০২:২০
Share: Save:

হোমে কিশোরীদের উপরে নির্যাতনের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। হিলির দুঃস্থ কিশোরীদের হোমের কর্ণধার দিলীপ মহন্তের প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, রাত হলেই কালো কাচে ঘেরা একটি ছোট গাড়ি করে হোমের মেয়েদের বালুরঘাটের শিবতলির মালোপাড়া এলাকার দিলীপবাবুর বাড়িতে আনা হত। কিন্তু ঘটনার ২৪ ঘন্টা কেটে গেলেও ওই গাড়িটি কে চালাত তা পুলিশ খুঁজে বার করতে পারেনি।

সোমবার হিলি থানার তিওড় এলাকায় জেলা সমাজকল্যাণ দফতরের আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্ত ধীরেন মহন্ত পাবলিক চ্যারিটিবল সোসাইটি নামে একটি বেসরকারি হোমের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপার ভক্তি সরকার লাহা থানায় হোমের কর্ণধার দিলীপ মোহান্তের বিরুদ্ধে কুকর্মের অভিযোগে সরব হন। হোমের তফসিলি জাতিভুক্ত আবাসিক দুঃস্থ বালিকা ও কিশোরীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে দিলীপবাবু বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতেন বলে ভক্তিদেবী থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। হোমের ৬ জন কিশোরীও বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কাছে মুখ খুললে রাজ্য জুড়ে আলোড়ন পড়ে যায়।

আবাসিক বালিকা ও কিশোরীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে মঙ্গলবার দক্ষিণ দিনাজপুরের তিওড় এলাকার ওই বেসরকারি হোমে পা দিয়েই চরম দৈন্যদশা দেখে আঁতকে উঠলেন জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিকেরা। এদিন সকাল ১১টা নাগাদ বালুরঘাট থেকে জেলা চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার জয়িতা মুখোপাধ্যাপাধ্যায় এবং চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির প্রতিনিধি শিউলি সরকার ওই হোমে যান। এদিন হোমের আবাসিকদের স্কুলে যেতে দেওয়া হয়নি।

হিলি থানার একটি পুলিশের গাড়ি হোমের সামনে সকল ১০টা থেকে মোতায়েন করা হয়। সিভিক ভলেন্টিয়ারদেরও গেটের বাইরে পাহারায় রাখা হয়। এরপর হোমের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপার ভক্তি সরকার লাহার উপস্থিতিতে দীর্ঘ সময় ধরে আবাসিক মেয়েদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন। সে সময় হোমের অব্যবস্থার ছবিটা তাঁদের কাছে তুলে ধরেন ছাত্রীরা। পরে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির প্রতিনিধি শিউলিদেবী বলেন, ‘‘নানা অব্যবস্থা আমরা দেখেছি, জেলাশাসককে আমরা রিপোর্ট দেব।’’

এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ তিওড়ে পৌঁছে দেখা যায়, ওই হোমে যেন শ্মশানের নীরবতা। বালুরঘাট থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে হিলি-বালুরঘাট সড়কে তিওড় এলাকার ওই হোমের একটি মাত্র দরজা। দেখা যায়, পর পর দুটো বড় ঘর। ৪০ জন থেকে ৬০ জন করে একটি ঘরে হোমের বালিকা ও কিশোরীদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়।

হোম সূত্রের খবর, একটি পাঁচ বাই ছয় হাত ছোট চৌকিতে এই গরমের মধ্যে ৪ জনকে ঠাসাঠাসি করে রাত কাটাতে হয়। বিশুদ্ধ পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যাপ্ত শৌচালয়। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থেকে অনেকে চর্মরোগে আক্রান্ত বলে অভিভাবকদের একাংশ অভিযোগ করেন। জেলা সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রে খবর, এক বছর আগে ওই হোমে সরকারি অর্থে একটি পরিস্রুত পানীয় জলের বৈদ্যুতিন ফিল্টার কিনে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক মাস ধরে তা অকেজো হয়ে থাকলেও মেরামতিতে কেউ উদ্যোগী হয়নি। বাধ্য হয়ে অসহায় ওই বালিকাদের আয়রনযুক্ত হস্তচালিত কলের জল পান করতে হয়।

দেড়শো জন আবাসিক রাখার সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত ওই হোমে গড়ে একশো জন থাকলেও চারটির বেশি শৌচালয় নেই। বাথরুমে কোনও জীবানুনাশক নেই। অথচ জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে তিন মাস আগে হিলির শ্রীরামপুর সীমান্তের এক পঞ্চম শ্রেণীর বালিকার হোমেই মৃত্যু হয়।

জেলাশাসক তাপস চৌধুরী বলেন, ‘‘সে সময় খবর পেয়ে আমি ও পুলিশ সুপার ওই হোমে যাই। অসুস্থ ওই বালিকাকে ডাক্তার না দেখিয়ে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ানো হয়েছিল। আমরা বালিকার বাবাকে হোমের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে করতে পারেন বলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু অভিভাবকেরা কোনও অভিযোগ করেননি।’’ হোম সূত্রের খবর, রাতে হোমের মধ্যে ওই বালিকার মৃত্যু হয়। সকালের মধ্যে মৃতার পরিবারের কাছে কর্ণধার দিলীপ মহন্তের লোকেরা পৌঁছে যান।

দিলীপবাবু পুলিশ থেকে শুরু করে সমাজকল্যাণ দফতরের একাংশ কর্মীকে নানা ভাবে হাত করে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ। এলাকা সূত্রে জানা গিয়েছে, বালুরঘাটের মালোপাড়ার গলিতে ২০০৫ সালে নতুন তিন তলা বাড়ি তৈরির পর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিলীপ থাকতেন। বছর ছয়েক আগে দিল্লিতে ফ্ল্যাট কিনে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে স্থানান্তর করে ওই বাড়িতে একাই থাকতেন দিলীপ। প্রথম দিকে অল্প বয়সী এক কিশোরী পরিচারিকাকে তাঁর বাড়িতে দেখা যেত। বাসিন্দারা জানান, কয়েক মাস পর ওই পরিচারিকাকে দেখা যায়নি। তারপর মাসের প্রতি রবিবার দিলীপবাবুকে ওই বাড়িতে দেখা যেত। বাকি দিনগুলির বেশিভাগ সময়ে বাড়িটি তালাবন্দি থাকত।

এদিন সকালে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘‘গত রবিবার শিবতলি বাজারে দিলীপবাবুকে দেখি অনেকটা খাসির মাংস কিনছেন। পরে জানতে পারি ওই মাংস খাওয়ানো হত ওই কিশোরীদের। তারপরে তাদের উপরে নির্যাতন করা হত।’’ বালুরঘাটের সাহেবকাছারি এলাকার এক আইসিডিএল কর্মীকে তাঁর বাড়িতে রাতে যেতে দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বালুরঘাট পুলিশ হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত এক চিকিৎসককেও দিলীপবাবুর বাড়িতে দেখা যেত। পাড়ার এক যুবক জানান, দিলীপের গাড়ির চালক কয়েকবছর আগে চাকরি পেয়ে চলে যান। এরপর তিওড় এলাকার এক পরিচিত যুবককে তার গাড়ির চালক রেখেছিলেন।

এদিন বেলা বাড়তে থাকলে দূরের গ্রাম থেকে অভিভাবকেরা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে, কেউ মেয়েদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হোমে আসেন। কিন্তু অভূতপূর্ব কড়াকড়ি চালু হয়ে যায়। বালুরঘাট থেকে মাত্র ১৬ কিমি দূরে থাকা ওই হোমের প্রতি সরকারি কর্তৃপক্ষের ঢিলাঢালা নজরদারি এদিন হঠাৎ করে বেড়ে যায়। শেষে দুপুর ২টা নাগাদ চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসারেরা হোম থেকে বের হলে অভিভাবকেরা তাদের মেয়েদের সঙ্গে বাইরের দরজা থেকে দেখা করতে পারেন। কিন্তু অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা তাতে এতটুকু কমেনি। মূল অভিযুক্ত দিলীপ যে অধরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE