Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সন্তানের কাছে ‘ব্রাত্য’ মাকে ফেরাল এলাকাবাসী

অবশেষে স্থানীয় কিছু মানুষের উদ্যোগে পুলিশের কাছে রীতিমতো আজীবন দেখভাল করার মুচলেকা দিয়ে মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন ছেলে। শুক্রবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে ব্যারাকপুরে।

ফেরা: মাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন গণেশ মণ্ডল।—নিজস্ব চিত্র।

ফেরা: মাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন গণেশ মণ্ডল।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:০১
Share: Save:

পুত্রবধূর আপত্তি ছিল, তাই ছেলের ঘরে ঠাঁই হয়নি বিধবা বৃদ্ধা মায়ের। মেয়ের বাড়িতে কোনও মতে মাথা গোঁজার জায়গা হলেও তা জামাইয়ের পছন্দ ছিল না। কার্যত সকলের ‘অবহেলা’ নিয়েই সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধার দিন চলছিল। কয়েক দিন আগে সেই মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি থেকেও বিতাড়িত হয়ে তাঁর ঠিকানা হয়েছিল রাস্তার ফুটপাথ!

অবশেষে স্থানীয় কিছু মানুষের উদ্যোগে পুলিশের কাছে রীতিমতো আজীবন দেখভাল করার মুচলেকা দিয়ে মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন ছেলে। শুক্রবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে ব্যারাকপুরে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলেজ ফেরত কিছু যুবক দেখেন ব্যারাকপুর সেন্ট্রাল রোড সংলগ্ন ‘ই’ রোডে ঢোকার মুখে একটি সোনার দোকানের ফুটপাথে শুয়ে ঠান্ডায় কাতরাচ্ছেন এক বৃদ্ধা। মলিন শাড়ি পরা বৃদ্ধার পাশে একটি বস্তা। অসংলগ্ন কথাবার্তা বললেও মাঝেমধ্যে তিনি অবশ্য ‘গণেশ’ বলে কেঁদে উঠছিলেন। রাত ১০টা নাগাদ এলাকার শাসক দলের নেতা-সহ প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা ব্যারাকপুর তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি মিলনকৃষ্ণ আঁশকে ফোন করে বিষয়টি জানান ওই পড়ুয়ারা। খবর পেয়েই মিলনবাবু-সহ কয়েকজন সেখানে চলে আসেন। তিনি বলেন, ‘‘বারবার গণেশ নামটা শুনে জানার চেষ্টা করি তিনি কে? শেষে জানতে পারি গণেশ তাঁর ছেলের নাম। বৃদ্ধার নাম বাসন্তী মণ্ডল।’’ বস্তা খুলে দেখা যায় তাতে রয়েছে কয়েকটি মলিন শাড়ি, চাদর। এর পরে স্থানীয় এক মহিলা এগিয়ে এসে ওই বৃদ্ধাকে মিষ্টি, জল খাওয়ান।

পুলিশ জানায়, এর পরে মিলনবাবুরা উদ্যোগী হয়ে ব্যারাকপুর স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ঘেঁষা তৃণমূল কার্যালয় খুলে সেখানেই বাসন্তীদেবীর রাতে থাকার ব্যবস্থা করেন। দেখভাল করার জন্য রয়ে যান স্থানীয় যুবক দুলু ঘোষ, গোপাল দাসেরা। বৃদ্ধার সঙ্গে গল্প করার সময়েই তাঁরা জানতে পারেন গণেশ টিটাগড়, ব্যারাকপুর এলাকায় রিকশা চালান। তাই এ দিন সকাল হতেই স্থানীয় রিকশা স্ট্যান্ডের চালকেরা এবং স্থানীয় যুবকেরা খোঁজ শুরু করেন গণেশের। এর মধ্যে অবশ্য দুলুবাবুরা কচুরি, তরকারি, জিলিপি এনে খাওয়ান বাসন্তীদেবীকে। দুলুবাবু বলেন, ‘‘উনি এমন গোগ্রাসে খাচ্ছিলেন, দেখে বোঝাই যাচ্ছিল অনেক দিন ভাল করে খেতে পাননি।’’

এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ চন্দনপুর লালবাজার থেকে গণেশকে ধরে ওই কার্যালয়ে নিয়ে আসেন আরও দুই রিকশা চালক ঝন্টু ও নারায়ণ। আসে টিটাগড় থানার পুলিশও। গণেশ জানান, তাঁদের বাড়ি টিটাগড় থানার দেবপুকুরের গণেশপুরে। বছর পাঁচেক আগে তাঁর বাবা সন্ন্যাসী মণ্ডলের মৃত্যু হয়েছে। বোন লক্ষ্মী মণ্ডলেরও বিয়ে হয়েছে ওই এলাকারই নিশিকান্ত মণ্ডলের সঙ্গে। গণেশ বলেন, ‘‘বৌ পূর্ণিমাকে নিয়ে ভাড়া ঘরে থাকি। ওই ছোট ঘরে মাকে রাখতে রাজি ছিল না পূর্ণিমা। রোজ অশান্তি থেকে রেহাই পেতে মা বোনের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন।’’

কিন্তু সেখানেও তাঁকে রাখা নিয়ে প্রায় রোজই অশান্তি করতেন জামাই নিশিকান্ত। বুধবার রাতে তিনি ঘর থেকে বের করে দেন বাসন্তীদেবীকে। আর তাই বৃহস্পতিবার থেকে ব্যারাকপুরের ওই ফুটপাথই হয়েছিল বৃদ্ধার একমাত্র আশ্রয়। তৃণমূল পরিচালিত ব্যারাকপুর রিকশা চালক সংগঠনের সভাপতি দুলু ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা সকলে নজর রাখব গণেশের উপরে। বলে দিয়েছি সমস্যা হলে আমাদের জানাতে। যতটা সম্ভব সহযোগিতা করব।’’ আর পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে গণেশ প্রতিজ্ঞা করছেন, ‘‘আর এমন ভুল করব না।’’

মা অবশ্য তখনও ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে চলেছেন ‘‘আমার গণেশ খুব ভাল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mother Son
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE