Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সব কথা ফাঁস করব, বার্তা ‘জেঠু’র ফোনে

থানায় বসেই ‘জেঠু’-কে এসএমএস পাঠিয়েছিলেন বিধাননগর পুরসভার কংগ্রেস প্রার্থী দেবরাজ চক্রবর্তী। লিখেছিলেন, ‘‘জেঠু, আমি অ্যারেস্ট হলাম। ভুল কিছু করিনি, তা-ও হলাম। আমি কাল প্রেসকে সব বলব তোমার আর দোলাদির ব্যাপারে। এত নীচে নামবে আমি জানতাম না। থ্যাঙ্ক ইউ।’’

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫১
Share: Save:

থানায় বসেই ‘জেঠু’-কে এসএমএস পাঠিয়েছিলেন বিধাননগর পুরসভার কংগ্রেস প্রার্থী দেবরাজ চক্রবর্তী। লিখেছিলেন, ‘‘জেঠু, আমি অ্যারেস্ট হলাম। ভুল কিছু করিনি, তা-ও হলাম। আমি কাল প্রেসকে সব বলব তোমার আর দোলাদির ব্যাপারে। এত নীচে নামবে আমি জানতাম না। থ্যাঙ্ক ইউ।’’

কে জেঠু? কে-ই বা দোলাদি?

দেবরাজের এই ‘জেঠু’ রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। আর ‘দোলাদি’ হলেন পূর্ণেন্দু-ঘনিষ্ঠ সাংসদ দোলা সেন।

কিন্তু এই হুমকি কেন? আর এই দু’জনের সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমকে কী-ই বা বলতে চেয়েছেন দেবরাজ?

তৃণমূল সূত্রেই খবর, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে পূর্ণেন্দুবাবুরই আপ্ত-সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন দেবরাজ। পূর্ণেন্দুবাবুর যাবতীয় কাজ দেখভাল করতেন তিনি। ঘনিষ্ঠতাও ছিল যথেষ্ট। দোলা সেনের সঙ্গেও যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল দেবরাজের। ফলে এই দু’জনের নাড়িনক্ষত্র জানতেন এই যুবক। কানাঘুষোয় শোনা যায়, দেবরাজের জানা এমন অনেক কথাই রয়েছে, যেগুলি প্রকাশ্যে এলে যারপরনাই বিব্রত হবেন তৃণমূলের এই দুই নেতা। তাই রবিবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার পর সেই প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়েই ‘জেঠু’-কে চাপে রাখতে চেয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী।

দেবরাজের এই কৌশলের কথা অস্বীকার করেননি পূর্ণেন্দুবাবুও। সোমবার বিকেলে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি ওই এসএমএস পাওয়ার কথা মেনে নেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘একটা এসএমএস পেয়েছিলাম। তা পুলিশকে দিয়েছি। ওর বয়স কম। রাগের মাথায় এ সব করছে। যা পারে করুক, আমি কী বলব!’’

কিন্তু পূর্ণেন্দুর আপ্ত-সহায়ক থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হলেন কেন দেবরাজ? তৃণমূলের অন্দরের খবর, দেবরাজের আশা ছিল আপ্ত-সহায়ককে পুরভোটের টিকিট পাইয়ে দেবেন পূর্ণেন্দু। কিন্তু তা না-হওয়ায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কয়েক দিন আগে আপ্ত-সহায়কের পদ ছেড়ে কংগ্রেসে আসেন তিনি। কংগ্রেস তাঁকে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী করে। দেবরাজ তৃণমূলের টিকিট কেন পেলেন না? দলীয় সূত্রের খবর, পূর্ণেন্দুর আপত্তি ছিল না প্রাথমিক ভাবে। কিন্তু ‘মুকুল-ঘনিষ্ঠ’ দেবরাজকে টিকিট দেওয়ার ব্যাপারে বেঁকে বসেন দোলা। তখন দেবরাজ কংগ্রেসে যান। তৃণমূলের একটি সূত্র বলছে, দেবরাজ কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়ানোর পরে তাঁকে ঘিরে দলে একটা আশঙ্কার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কারণ, মন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক হওয়ায় এবং নিজে বয়সে তরুণ হওয়ায় দেবরাজের জনপ্রিয়তা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী খুরশিদ আলম হেরে যেতে পারেন কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা বলছেন, ‘‘দেবরাজ কাউন্সিলর হয়ে গেলে তৃণমূলের স্থানীয় স্তরে ভাঙনও ধরতে পারে। সেটা চাননি দলের নেতারা।’’ তাই ভোট প্রচার শুরু হতেই দেবরাজকে চাপে রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। তাতে পুলিশকেও কাজে লাগানো হয়েছিল বলে ওই নেতার দাবি।

এ দিন বারাসত আদালত চত্বরে খোদ দেবরাজকে তাঁর ওই এসএমএস নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়। সংবাদমাধ্যমকে তিনি কী বলতে চান, জানতে চাওয়া হয় তা-ও। দেবরাজের জবাব, ‘‘এখন নয়, এ ব্যাপারে পরে বলব।’’

দেবরাজ মুখ খুললে ঠিক কী কী বলতে পারেন, তার কিছু আঁচ অবশ্য কংগ্রেস এবং তৃণমূল সূত্রে মিলেছে। বাগুইআটির কংগ্রেস নেতা সোমেশ্বর বাগুই যেমন এ দিন আদালতের বাইরে বলেন, ‘‘পূর্ণেন্দু-দোলার অনেক গোপন খবর দেবরাজ জানে। সেগুলোই ও সংবাদমাধ্যমকে বলতে চেয়েছিল।’’ অনেক নেতার নানা ‘অনৈতিক’ কাজকর্ম সম্পর্কে যে তাঁর কাছে অনেক

তথ্য রয়েছে, সে কথা দেবরাজ নিজেও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন।

কী রকম? পুলিশ সূত্রের খবর, রাজারহাট-গোপালপুর এলাকায় সিন্ডিকেট ব্যবসা, পানশালার কারবারের রমরমা। একের পর এক বহুতল উঠতে থাকায় সেখানে ইমারতি মালপত্রের সরবরাহের বরাত নিয়ে শাসক দলের একাধিক গোষ্ঠীর গোলমাল রয়েছে। তা নিয়ে খুন, জখমের ঘটনাও ঘটেছে। ওই এলাকার বহু পানশালাতেও নানা বেআইনি কাজ-কারবার চলে বলে অভিযোগ। তা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে কয়েকটি পানশালায় পুলিশি অভিযানও চলেছে। কংগ্রেস ও তৃণমূলের একাধিক নেতা বলছেন, এ সব কারবারের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের যে সুসম্পর্ক রয়েছে, তা এলাকার অনেকেই জানেন। সেই সব ‘সম্পর্কের’ ঘাঁতঘোঁত দেবরাজ জানতেন বলে তৃণমূলের একাংশের দাবি। দলীয় সূত্রের খবর, বাগুইআটি এলাকার এক দুষ্কৃতী এবং প্রোমোটারের সঙ্গে তৃণমূলের একাংশের ঘনিষ্ঠতার অনেক তথ্য রয়েছে দেবরাজের কাছে। এ বার পুরভোটে ওই প্রোমোটার টিকিট না পেয়ে দলের হয়ে কাজ করছিলেন না। পরে উপরমহল থেকে হুমকি দিয়ে তাঁকে দলের কাজে নামানো হয়। দেবরাজ-ঘনিষ্ঠ এক কংগ্রেস নেতা দাবি করছেন, ‘‘ওই দুষ্কৃতী নানা অপরাধমূলক কাজ করেও যে নেতাদের সাহায্যে ছাড় পেয়ে যান, সেগুলি ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলেছেন দেবরাজ।’’

দেবরাজ গ্রেফতার হলেন কী ভাবে?

পুলিশ সূত্রের খবর, দেবরাজের নির্বাচনী এজেন্টকে ভোটের আগের দিন রাত পর্যন্ত বাগুইআটি থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। শনিবার বিকেলে কৈখালিতে গুলি চলার পর বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে সেখানে হাজির হন রাজ্য পুলিশের ডিএসপি অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাগুইআটি থানার আইসি সুকোমলকান্তি দাস। হামলাকারী চলে যাওয়ার পরে সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন দেবরাজ। সংবাদমাধ্যমের সামনেই হঠাৎ দেবরাজের কলার টেনে ধরেন এক পুলিশকর্মী। তাঁর গালে থাপ্পড় মারেন আইসি। তাঁর পর দেবরাজের পকেট থেকে একটি পেন তুলে নিয়ে হুমকির সুরে বলেন, ‘‘পেন-ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছিস?’’ সেটিকে রাস্তায় আছড়ে জুতো দিয়ে পিষে দেন। তার পর দেবরাজকে তুলে নিয়ে থানায় চলে যায় একটি গাড়ি। রাতের দিকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জেলা কংগ্রেস সভাপতি তাপস মজুমদার পুলিশকে দেবরাজের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে আইসি উত্তর দেন, ‘‘আটকে ছিলাম। ছেড়েও তো দিয়েছি।’’

এর পরে রবিবার রাতে ফের দেবরাজকে থানায় নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ। কেন?

দমদমের তৃণমূল কাউন্সিলর সত্যব্রত সাঁতরার অভিযোগ, ভোটের দিন কৈখালি এলাকার তৃণমূল অফিসে ঢুকে হামলা চালান দেবরাজ। যদিও সত্যব্রত দমদম থেকে কৈখালি গিয়েছিলেন কেন, তার সদুত্তর নেই। কংগ্রেসের দাবি, এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। দেবরাজকে বেকায়দায় ফেলতেই সাজানো অভিযোগ আনা হচ্ছে। ‘‘দেবরাজকে জেলে পুরতে হবে, এমন নির্দেশ এসেছিল,’’ নাম না-করে জানিয়েছেন এক পুলিশ অফিসারও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE