Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সব করেছেন মমতা, মানছে না নথি

আগেই ঘোষণা ছিল, প্রতি‌শ্রুতির ৯০% কাজ শেষ করে ফেলেছে তাঁর সরকার। শুক্রবার পরমা উড়ালপুলের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফের দাবি, ‘‘বামেরা ৩৪ বছরে শুধু দেনা করেছে। উন্নয়ন করেনি। যা উন্নয়ন হয়েছে সবই আমার আমলে।’’ কিন্তু সরকারি নথি বলছে, এই আমলে শেষ হওয়া বেশির ভাগ বড় প্রকল্পই যাত্রা শুরু করেছিল বাম জমানায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

আগেই ঘোষণা ছিল, প্রতি‌শ্রুতির ৯০% কাজ শেষ করে ফেলেছে তাঁর সরকার। শুক্রবার পরমা উড়ালপুলের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফের দাবি, ‘‘বামেরা ৩৪ বছরে শুধু দেনা করেছে। উন্নয়ন করেনি। যা উন্নয়ন হয়েছে সবই আমার আমলে।’’ কিন্তু সরকারি নথি বলছে, এই আমলে শেষ হওয়া বেশির ভাগ বড় প্রকল্পই যাত্রা শুরু করেছিল বাম জমানায়।

সরকারি কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, যে সব প্রকল্প আগে শুরু হয়েছিল, তা তো এক দিন শেষ হবেই। মাঝে সরকার বদলেছে। কিন্তু সেজন্য কি সব প্রকল্পের কৃতিত্ব নিজের সরকারের বলে দাবি করা যুক্তিসঙ্গত? তাঁদের মতে, যে সব প্রকল্প এই সরকার হাতে নিয়েছে বা নিচ্ছে, তার অনেকগুলিই যদি অন্য কোনও সরকারের আমলে শেষ হয়, তার পুরো কৃতিত্ব কি তারা দাবি করতে পারে? তখন তো এই সরকারকেও কৃতিত্ব দিতে হবে।

মুখ্যমন্ত্রী নিজেও সেই তত্ত্ব মানেন। তবে ক্ষেত্র বিশেষে। যেমন, সম্প্রতি বার্নপুরের ইস্কো কারখানার সম্প্রসারণ প্রকল্পের উদ্বোধনের কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করলেও তা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন আমার চাপেই ইস্কোর সম্প্রসারণ প্রকল্প শুরু হয়েছিল। তাই এই কাজের শিরোপা নরেন্দ্র মোদী একা পেতে পারেন না।’’

মমতার সেই যুক্তি মেনেই বলা যায়, তিনি এখন যে সব প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন তার জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারও কিছু কৃতিত্বের দাবিদার। যেমন, পরমা উড়ালপুল। নবান্ন সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প হিসেবে ২০০৭-০৮ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। তবে ২০১১ সালে বাম আমলের যবনিকা পতনের সময় প্রকল্পের কাজ অনেকটা এগিয়ে গেলেও শেষ হয়নি। তৃণমূল আমলে কাজ শুরু হলেও মাঝপথে তা থমকে যায়। সরকারি কর্তারা জানাচ্ছেন, প্রস্তাবিত উড়ালপুলের পথে চার নম্বর ব্রিজের আশপাশ থেকে জবরদখলকারীদের সরাতে না পারা, কিছু অংশে জমি না পাওয়া এবং পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড়ের কাছে নিকাশি ব্যবস্থাকে বাঁচাতে উড়ালপুলের নকশা বদল করতে হয়। প্রকল্প রূপায়ণে দেরি হওয়ায় খরচও বেড়ে যায় অনেকটাই। এই নিয়ে সরকারের সঙ্গে নির্মাণ সংস্থার দীর্ঘ আলোচনার পর ফের কাজ শুরু হয়ে এ দিন তার উদ্বোধন হল।

একই ভাবে এই আমলে উদ্বোধন হওয়া উল্টোডাঙা বা নাগেরবাজার উড়ালপুল, ভিআইপি রোডের উপরে বাগুইআটি উড়ালপুলের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল বাম আমলে। পদ্মপুকুর-কামালগাজি উড়ালপুলের কাজ বাম আমলে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। বাম মন্ত্রিসভার এক প্রাক্তন সদস্যের দাবি, এই সব উড়ালপুলই কেন্দ্রের টাকায় ২০০৭-০৮ সালে শুরু হয়েছিল। ১৫৪ কোটি টাকা খরচে ২০০৮ সালে বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুল তৈরির কাজে হাত দেওয়া হলেও এখনও তা দিনের আলো দেখেনি। উড়ালপুল তৈরির কৃতিত্ব মুখ্যমন্ত্রী দাবি করলেও তাঁর সরকারের একাধিক কর্তা জানান, মেটিয়াবুরুজ থেকে বজবজ পর্যন্ত সাড়ে সাত কিলোমিটার উড়ালপুল তৈরির পরিকল্পনা করেছে এই সরকার। শহর ও লাগোয়া এলাকার বাকি সব উড়ালপুলের পরিকল্পনাই বাম আমলের।

শুধু উড়ালপুল নয়, শিল্পের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী একই দাবি করছেন বলে অভিযোগ বামেদের। উদাহরণ দিয়ে তাঁদের দাবি, ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পাশে নিয়ে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় বিমানমন্ত্রী প্রফুল্ল পটেল অন্ডালে বেসরকারি বিমানবন্দরের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তার পর জমি অধিগ্রহণ থেকে নির্মাণের অনেক কাজই শুরু হয় আগের আমলে। জমানা বদলের পরে প্রথম দিকে এই সরকারের সঙ্গে বিরোধের জেরে বিমানবন্দর তৈরির কাজ বন্ধ ছিল। সম্প্রতি জট কাটিয়ে বিমানবন্দরের উদ্বোধন হয়েছে। তবে বিমান-উপনগরী তৈরির কাজ কবে শেষ হবে, তা কেউ জানে না।

প্রশাসনের একাংশের দাবি, কাটোয়ায় এনটিপিসি-র তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, ডোমজুড়ে গয়নাশিল্পের পার্ক তৈরির পরিকল্পনা আগের আমলের। এমনকী, যে প্রকল্প নিয়ে অমিতবাবু সব বণিক সম্মেলনে বড়াই করে বলেন, সেই টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস-এর রাজারহাটের ক্যাম্পাসও বাম আমলেই পরিকল্পিত। জমিও বিগত সরকারের আমলেই পায় টিসিএস। এবং বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের তকমাও তখনই পায় তারা। মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাফল্যের’ তালিকায় থাকা পানাগড় শিল্প তালুকে ম্যাটিক্স ও জনসন সেরামিক টাইলসের বিনিয়োগ, খড়্গপুরে বিদ্যাসাগর শিল্প তালুকে টাটা হিতাচি-সহ অন্যান্য বিনিয়োগের পরিকল্পনাও বাম আমলেরই ফসল। এক শিল্প কর্তার কথায়, ‘‘বাম আমলে শুরু যে সব প্রকল্পের কাজ এখন শেষ হচ্ছে তার কৃতিত্ব মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন। আবার, তিনি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন যে সব কাজ শুরু করেছিলেন (এখনও শেষ হয়নি), তারও কৃতিত্বও

এখন দাবি করছেন তিনি। এ তো স্পষ্টতই স্ববিরোধিতা।’’

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিনও দাবি করেন, ‘‘রাজ্যের জন্য প্রচুর রেল প্রকল্প দিয়েছিলাম। যেমন, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো, জোকা-বিবাদী বাগ, নিউ গড়িয়া-এয়ারপোর্ট, দক্ষিণেশ্বর-দমদম, দমদম-ব্যারাকপুর, ব্যারাকপুর-কল্যাণী পথে মেট্রো রেল চলবে। ঢেলে করে দিয়েছি। দু’তিন বছরের মধ্যে পরিবহণের আর কোনও সমস্যা থাকবে না।’’ মমতার আরও দাবি, এই আমলেই রাজ্যে এক হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে হচ্ছে আরও তিন হাজার কিলোমিটার।

মুখ্যমন্ত্রী যখন এই দাবি করছেন, তখন শিল্প মহলের প্রশ্ন, যে সব প্রকল্প এই আমলে রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়েছে, সেই তালিকাও ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। বন্ধ হয়েছে বহু কারখানা। এখনও বন্ধ বেশ কয়েকটি চটকল। এই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নীরব কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE