Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
লগ্নি-তদন্তের সুতোয় আচমকা জব্বর টান

গ্রেফতার মনোরঞ্জনা-শান্তনু, দীর্ঘ জেরা সস্ত্রীক তাপস পালকে

অবৈধ লগ্নি সংস্থার কাজ-কারবার নিয়ে সিবিআই-ইডি’র তৎপরতায় ইদানীং ভাটার টান ধরেছিল। ক্রমশ যেন ঢিমে হয়ে আসছিল তদন্তের আঁচ। যা দেখে বিভিন্ন মহলে মাথা চাড়া দিয়েছিল প্রশ্ন— সব কি শেষমেশ ধামাচাপা পড়ে যাবে?

সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরোচ্ছেন তাপস পাল। সঙ্গে স্ত্রী নন্দিনী। বুধবার। — নিজস্ব চিত্র

সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরোচ্ছেন তাপস পাল। সঙ্গে স্ত্রী নন্দিনী। বুধবার। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

অবৈধ লগ্নি সংস্থার কাজ-কারবার নিয়ে সিবিআই-ইডি’র তৎপরতায় ইদানীং ভাটার টান ধরেছিল। ক্রমশ যেন ঢিমে হয়ে আসছিল তদন্তের আঁচ। যা দেখে বিভিন্ন মহলে মাথা চাড়া দিয়েছিল প্রশ্ন— সব কি শেষমেশ ধামাচাপা পড়ে যাবে?

ঠিক এমন একটা সময়ে তদন্তের সুতোয় জোর টান পড়েছে। যার সূত্রে ফের সামনে চলে এসেছে তিনটি বড় নাম— মনোরঞ্জনা সিংহ, শান্তনু ঘোষ ও তাপস পাল। বুধবার সিবিআই সারদা-কেলেঙ্কারি মামলায় ব্যবসায়ী মনোরঞ্জনা ও শান্তনুকে গ্রেফতার করেছে। আর রোজ ভ্যালি-মামলায় এ দিন দীর্ঘক্ষণ সিবিআই-জেরার মুখে পড়েছেন তৃণমূলের অভিনেতা-সাংসদ তাপস পাল।

সূত্রের খবর: প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ মাতঙ্গ সিংহের স্ত্রী মনোরঞ্জনা টাকা নিয়েছিলেন সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে। অভিযোগ, টাকা নিয়েও তিনি চুক্তি মতো কাজ করেননি। উপরন্তু তথ্য গোপন করে তদন্তকারীদের গোড়া থেকে বিপথে চালিত করেছেন। সিবিআইয়ের যুক্তি, মনোরঞ্জনা সমাজের ‘প্রভাবশালী’দের এক জন, কেলেঙ্কারির নেপথ্যে যাঁদের ভূমিকা খুঁজে বার করার দায়িত্বও ব্যুরোর উপরে বর্তেছে। অন্য দিকে উঠতি ব্যবসায়ী শান্তনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সুদীপ্তকে ‘বুঝিয়ে-সুঝিয়ে’ লোকসানে চলা নিজের কারখানা তিনি দু’শো কোটি টাকায় বেচেছিলেন। সারদা-আমানতের অর্থ নয়ছয়ের খেলায় এই ভাবে তিনিও জড়িয়ে গিয়েছেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। মনোরঞ্জনা, শান্তনু— দু’জনকেই এ দিন সল্টলেকের সিবিআই অফিসে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। যদিও সকাল থেকে সংবাদমাধ্যমের সিংহভাগ নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তাপস পাল। রোজ ভ্যালি মামলায় এ দিন তাঁরও তলব পড়েছিল সিবিআই অফিসে। তাপস সস্ত্রীক সেখানে আসেন। শাসকদলের সাংসদকে অবশ্য সকাল এগারোটা থেকে তিনটে পর্যন্ত জেরা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

সুদীপ্ত সেনের থেকে হিসেব বহির্ভূত টাকা নেওয়ার অভিযোগে মনোরঞ্জনার স্বামী মাতঙ্গকে সিবিআই ইতিমধ্যে গ্রেফতার করেছে। সিবিআই-ইডি এর আগে মনোরঞ্জনাকেও বেশ কয়েক বার ডেকে জেরা করেছিল। কেলেঙ্কারিতে ওঁর ভূমিকা কী?

সিবিআই-সূত্রের ব্যাখ্যা: ওঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে গুয়াহাটিতে একটি সংবাদ চ্যানেল চালাতেন। তখনই মনোরঞ্জনার সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের ৪২ কোটি টাকার চুক্তি হয়। র শর্ত ছিল, মনোরঞ্জনা একটি সংবাদ চ্যানেল তৈরি করবেন, যার উপরে সারদার নিয়ন্ত্রণ যেমন থাকবে, তেমন সেটি মারফত সারদার প্রচারও চলবে। মনোরঞ্জনা চ্যানেল চালুও করেছিলেন। তবে তা বেশি দিন টেকেনি। পরে সিবিআই’কে লেখা চিঠিতে সুদীপ্ত অভিযোগ করেন, চুক্তির খেলাপ করেছেন মনোরঞ্জনা। সারদা-কর্তার দাবি: চুক্তি অনুযায়ী কাজ তো হয়ইনি, উল্টে মনোরঞ্জনা মাঝে-মধ্যেই চাপ দিয়ে প্রচুর বাড়তি টাকা নিয়েছেন। কখনও ছেলেকে বিদেশে পড়ানোর কথা বলে, কখনও বা বিমানভাড়ার খরচ হিসেবে। সূত্রের খবর, আগে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে মনোরঞ্জনা জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে সুদীপ্তের লেনদেনের মধ্যে ছিলেন ব্যবসায়ী রমেশ গাঁধীও। মাতঙ্গের মতো রমেশকেও সারদা-মামলায় সিবিআই গ্রেফতার করেছে। আর মাতঙ্গ-মনোরঞ্জনার বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে আদালতে।

অন্য দিকে সারদা-সূত্রে গত কয়েক মাসে একাধিক বার শিরোনামে এসেছে কলকাতার ব্যবসায়ী শান্তনু ঘোষের নাম। এর আগে সারদা-তদন্তে নেমে তাঁকে গ্রেফতারও করেছিল ইডি। পরে তিনি জামিন পেয়ে যান। এ দিন তাঁকে গ্রেফতারের পরে সিবিআই-অফিসারেরা জানিয়েছেন, সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে শান্তনুর এমন কিছু আর্থিক লেনদেন হয়েছিল, যা ঘিরে বিস্তর ধোঁয়াশা। জেনাইটিস নামে মোটরবাইক তৈরির একটি কারখানা ছিল শান্তনুর। বাজার থেকে বেআইনি ভাবে তোলা আমানতের দৌলতে সুদীপ্ত সেনের যখন রমরমা, তখন শান্তনু ওঁর কারখানাটি সুদীপ্তকে বিক্রি করে দেন। এবং তা করতে গিয়ে তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। কী রকম?

তদন্তকারী-সূত্রের খবর: কারখানা বিক্রির জন্য দু’শো কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল। তখন সুদীপ্তকে বলা হয়েছিল, কারখানায় ১২০০ মোটরসাইকেল তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। সুদীপ্ত পরে গিয়ে দেখেন, একটিও নেই! উপরন্তু অভিযোগ, বিক্রির কিছু দিন আগে ওই কারখানাটিকেই ‘সম্পদ’ (অ্যাসেট) হিসেবে দেখিয়ে ১৩০ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক-ঋণ নিয়েছিলেন শান্তনু। পরে সেই দেনার দায়ভার সমেত কারখানা বেচে দেন সুদীপ্তকে।

অথচ বিক্রি বাবদ পাওয়া দু’শো কোটি ও ব্যাঙ্ক-ঋণের ১৩০ কোটি— মোট ৩৩০ কোটি টাকা দিয়ে শান্তনু কী করলেন, তার কোনও সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি বলে অভিযোগ। তদন্তকারীদের একাংশের সন্দেহ, ওই টাকা হাওয়ালা মারফত দেশের বাইরে পাঠানো হয়ে থাকতে পারে। অন্য দিকে সুদীপ্তের দাবি, কারখানা কেনার পরে তিনি জানতে পেরেছিলেন, কর্মীদের প্রায় ছ’কোটি টাকা বেতনও বকেয়া পড়ে রয়েছে।

পাশাপাশি রোজ ভ্যালি-কাণ্ডে এ দিন ফের সামনে উঠে এসেছে তাপস পালের নাম। মাস তিনেক আগে সিবিআই তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে হানা দিয়ে কিছু
কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করেছিল। তার পরে এ দিন ওঁকে তলব করে ঘণ্টা চারেক জেরা করেছেন গোয়েন্দারা। উল্লেখ্য, রোজ ভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুকে ইডি আগেই গ্রেফতার করেছে, তিনি এখন হাসপাতালে। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর শিবময় দত্ত ও আগরতলার ডিরেক্টর অশোক সাহা ধরা পড়েছেন সিবিআইয়ের হাতে। তাপসের সঙ্গে রোজ ভ্যালির সম্পর্কটা কী রকম?


মনোরঞ্জনা সিংহ। বুধবার সিজিও কমপ্লেক্সে। ছবি: শৌভিক দে।

সূত্রের খবর: গৌতম কুণ্ডু ২০০৯-এ ‘ব্র্যান্ড-ভ্যালু কমিউনিকেশন’ খোলার পরে কোম্পানিটির অন্যতম ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন এমপি তাপস পাল। এর পরে চালু হয় ‘রূপসী বাংলা’ চ্যানেল, যার লাইসেন্স পেতে মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনিই। সাংসদের স্ত্রী নন্দিনী ওই চ্যানেলে ‘ব্যাঞ্জন বর্ণ’ নামে একটি রান্নার অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে থাকেন। সংস্থায় তাঁর পদ ছিল সিনিয়র প্রডিউসারের। সংস্থা-সূত্রের খবর, গত ২৫ মার্চ গৌতম গ্রেফতার হলে নন্দিনী পদ ছাড়েন।

তাপস অবশ্য ডিরেক্টর পদ আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে সংস্থার পরামর্শদাতা হিসেবে তাঁর নাম ছিল। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, রোজ ভ্যালির ফিল্ম ডিভিশনের ডিরেক্টর হিসেবে তাপস মাসে প্রায় এক লক্ষ টাকা বেতন পেতেন। অন্যান্য খাতেও টাকা পেতেন। তদন্তকারীদের দাবি: চুক্তি অনুযায়ী যা প্রাপ্য, তার বাইরে রোজ ভ্যালির তিনটি অ্যাকাউন্ট থেকে তাপস পালের অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন সময়ে মোট প্রায় এক কোটি টাকা পাঠানো হয়েছে!

কেন, তা খতিয়ে দেখছে সিবিআই। বস্তুত সে প্রসঙ্গেই এ দিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে ব্যুরো-সূত্রের ইঙ্গিত। সূত্রের দাবি, তাপস ডিরেক্টর থাকাকালীন ফিল্ম ডিভিশনের হিসেবপত্রে প্রায় দশ কোটি টাকা গরমিলের সন্ধান মিলেছে। তদন্তকারীরা এ-ও জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার অবৈধ কাজকর্ম সম্পর্কে নালিশ জানিয়ে তাপস এক বার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন, সাংসদ হিসেবে। ‘‘সেই চিঠিতে সারদা, আইকোর, এমপিএস-সহ নানা সংস্থার নাম থাকলেও রোজ ভ্যালির নাম কিন্তু ছিল না!’’— বলছেন এক গোয়েন্দা।

রোজ ভ্যালির স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যেই সাংসদ চিঠিটি লিখেছিলেন কিনা, সেটাও তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE