১৪ নভেম্বর, ২০০৭। নীরব মিছিলের হুঙ্কার। ছবি: সুদীপ আচার্য।
একটু কান পাতলেই স্লোগানটা এখন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। পরিবর্তনের পরিবর্তন চাই। বিবিধ কারণে। ছাত্র নিপীড়ন, নারী ধর্ষণ, অপশাসন, শাসক দলের হাতে ক্রীড়নক পুলিশ-প্রশাসন...। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছর পর রাজনৈতিক পালাবদলের তিন বছরের মধ্যেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এক বিরোধী জোটের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক জোট অবশ্যই, কিন্তু তাকে শুধু রাজনৈতিক দলের জোট হলে চলবে না। তা হলে কেমন হবে সেই জোট?
বিমান বসু একদা কথাটা বলেছিলেন বক্রোক্তি করে। আর সেই একই কথা ইতিবাচক অর্থে বলেছিলেন কবীর সুমন। কিন্তু সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক আর সেই সময়ে তৃণমূল সাংসদ ব্যবহার করেছিলেন অভিন্ন শব্দ যুগল। রামধনু জোট। রেনবো অ্যালায়েন্স।
২০০৯-এর লোকসভা ভোটে তৃণমূল-কংগ্রেস-এসইউসি জোটের চমকপ্রদ সাফল্যের কিছু কাল পর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক রামধনু জোট কথাটা বলে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ওই জোটে সামিল দলগুলোর প্রতিটির রং আলাদা, অর্থাৎ নীতি, পন্থা ও আদর্শের নিরিখে একটা দলের সঙ্গে অন্যটার মিল নেই। কিন্তু সাংসদ হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে যখন সরব হলেন যাদবপুরের তদানীন্তন সাংসদ, তখন ওই একই শব্দ যুগল তিনি ব্যবহার করেছিলেন ভিন্ন প্রেক্ষিতে। কবীরের বক্তব্য ছিল, তিনি ও আরও কয়েক জন প্রকৃত অর্থে তৃণমূলে নয়, রামধনু জোটেই যোগ দিয়েছিলেন, অথচ সেই জোটের কথা তৃণমূল নেতৃত্ব এখন মাথায় রাখছেন না।
গত বিধানসভা ভোটের সময়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় শতাংশের হিসেব দিয়ে বার বার বোঝাতেন, বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের নির্বাচনী জোট হওয়া কতটা জরুরি (কংগ্রেসের পক্ষে অসম্মানজনক শর্তে রাজি হতে হলেও সমস্যা নেই)। এবং যখন বলতেন, তখন অবশ্যই বিস্মৃত হতেন, কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট ২০০১-এর বিধানসভা ভোটেও হয়েছিল, কিন্তু বামফ্রন্টকে হারানো যায়নি। আসলে তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট (এসইউসিআই-ও ছিল অবশ্য) শুধু ওই দু’টি রাজনৈতিক দলের জোট ছিল না। ওটি ছিল নানা শক্তির সন্নিবেশ, বহু গোষ্ঠীর মেলবন্ধন।
পরিবর্তনের সেই ভোট তখন মাঝপথে। বিভিন্ন সমীক্ষায় ইঙ্গিত, বামফ্রন্ট ঝড়ের মুখে দিশেহারা। রাঢ়বঙ্গের এক দাপুটে সিপিএম নেতা ও পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বলছিলেন, “এতগুলো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর হেরে যেতেই পারি। সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু তৃণমূলের মতো দলের কাছে হারব, এটা মেনে নেওয়া সম্ভব?” তাঁকে বোঝানো গিয়েছিল, এই হার তৃণমূলের কাছে হার নয়, তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের কাছেও হার নয়, বামফ্রন্ট আসলে হেরে যাচ্ছে একত্রিত হওয়া অনেকগুলো শক্তির কাছে। আর নির্বাচনী শক্তির বিচারে সব চেয়ে শক্তিশালী বলে তৃণমূল সেই পুরোপুরি অবয়ব না পাওয়া জোটের ‘ভ্যানগার্ড’-এর ভূমিকায়, অর্থাৎ অগ্রভাগে রয়েছে। এবং সে জন্যই আদতে রামধনু জোটের জয়কে অধিকাংশ মানুষ তৃণমূলের জয় বলে ঠাউরেছেন।
বস্তুত, সাতরঙা (নাকি আরও বেশি রং?) ওই জোটে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল এবং এসইউসি-র মতো রাজনৈতিক দল যেমন, তেমনই মাওবাদী বা অতি-বাম রাজনীতির সমর্থক, বিক্ষুব্ধ সিপিএম, প্রাক্তন নকশালপন্থী, সিপিএম তথা বামফ্রন্ট থেকে ছিটকে যাওয়া, সিপিএম তথা বামফ্রন্টের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হওয়া বিভিন্ন শক্তি গিয়ে মিশেছিল। এমনকী, ‘বাস্তব পরিস্থিতি’র কথা চিন্তা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান বলে ঘোষণা করেছিলেন মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজি। একই ভাবে সেই শক্তিতে সামিল হয়েছিল বিদ্বজ্জন বা নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের একাংশ— রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালান বল তাঁর ‘মডার্ন পলিটিক্স অ্যান্ড গভর্নমেন্ট’ বইয়ে বহু যুগ আগেই যাঁদের অভিহিত করেছেন ‘প্রেশার গ্রুপ’ বা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নামে। এবং যাদের ক্ষমতা, অ্যালান মনে করেন, রাজনৈতিক দলের চেয়ে খুব কম কিছু নয়।
বিগত বামফ্রন্ট সরকার ও পূবর্তন প্রধান শাসকদল সিপিএমের বিরুদ্ধে সেই চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রচণ্ড দাপট দেখা গিয়েছিল ২০০৭-এর নভেম্বরে। নন্দীগ্রামে বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শাসকদলের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব ‘অপারেশন সূর্যোদয়’-এর ঠিক পরে। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিশাল নীরব মিছিলে ছিল সেই প্ল্যাকার্ড ‘দেখালে তুমি এমন সূর্যোদয়/ভিতর-বাহির আঁধার হয়ে যায়।’ সে দিনই কেঁপে গিয়েছিল ৩০ বছরের শাসনের জগদ্দল পাথর।
আর সেই পরিবর্তনেরও যে পরিবর্তন দরকার, সম্প্রতি সেই আবহ তৈরি হয়েছে। অথচ অঙ্কের হিসেবেই বিরোধী কোনও একটি দলের পক্ষে তৃণমূল সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাটা বৃত্তকে চতুষ্কোণ করার মতোই কঠিন। আবার সেই সময় সিপিএমকে হটাতে বিজেপি বাদে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একজোট হলেও এখন তৃণমূলকে হটাতে সিপিএম-বিজেপি-কংগ্রেসের এক ছাতার তলায় আসা মুশকিল, এলে প্রায় সবারই অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা এই বঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণের নিরিখে। সিপিএম-বিজেপি জোট হতে পারবে না, বিজেপি-কংগ্রেস এক বন্ধনীতে আসবে না আবার সিপিএম-কংগ্রেস অতীতে মিলেজুলে কেন্দ্রে সরকার চালালেও রাজ্যে সেই মিলন দু’দলের সমর্থকদের কাছেই হাস্যকর হবে।
আর এই অবস্থাতেই ফের জরুরি হয়ে পড়েছে নতুন এক রামধনু জোটের। রাজ্যের ক্ষমতায় এসে মমতা আগের রামধনু জোট আর রাখেননি, ক্রমশ পুরোটাই সবুজ করে দিয়েছেন নিজের সুবিধা মতো। কাজেই, সেই জোটে যে সব শক্তির সমাবেশ হয়েছিল, সেই সব শক্তি এখন নানা দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। নতুন করে সেই সব শক্তির সন্নিবেশ কিছুটা হলেও দেখা গিয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর কলকাতার রাজপথে। যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ডাকে পড়ুয়াদের উপর পুলিশি তাণ্ডবের প্রতিবাদে ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় বেরোল বিশাল মিছিল। ওই মিছিলে যোগ দেওয়া এক বান্ধবীর সংক্ষিপ্ত পোস্ট সোশ্যাল নেটওয়ার্কে: ‘মাননীয়া, ওটা শুধু ৭০ হাজারের কলরব ছিল, গর্জন হলে সামলাতে পারবেন তো? ইতি, ওই ৭০ হাজারের এক জন।’
তবু, এ সব যথেষ্ট নয়। সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামের সময়ে ধাক্কাটা প্রথম লেগেছিল গ্রামে, তার পর জেগেছিল নাগরিক সমাজ। গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে একটা ধারণা ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, বামফ্রন্ট সরকারের জমানায় কৃষকের চাষের জমি আর নিরাপদ নয়। সেটা ভুল বা ঠিক যা-ই হোক। গ্রামবাংলায় এখনও তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে ওই ধরনের হাওয়া ওঠার লক্ষণ নেই। সারদা কেলেঙ্কারি এই রাজ্যে এখনও পর্যন্ত সব চেয়ে বড় আর্থিক অনিয়ম হলেও, সেই ব্যাপারে তৃণমূলের কয়েক জন শীর্ষনেতা ও মন্ত্রী আলোচনায় টীকা-টিপ্পনীর খোরাক হলেও ইভিএমে শাসক দলের বিরুদ্ধে সেই অসন্তোষ দানা বাঁধছে না গ্রামবাংলায়। অর্থাৎ শাসক দল এখনও প্রবল পরাক্রমশালী হিসেবে সামনে দাঁড়িয়ে।
আর বর্তমান শাসক দলের বিরুদ্ধে মানুষ একজোট হয়ে ভোটটা দেবেন কাকে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি, আদর্শ ও রাজনীতির ধরন মেনে নিতে যাঁদের সমস্যা এবং মস্তিষ্কের স্থিরতা নিয়ে যাঁদের প্রশ্ন, তাঁরাও কিন্তু বিরোধী নেত্রী হিসেবে সিপিএমকে উৎখাত করতে তাঁর লাগাতার লড়াই ও আন্দোলনকে কোনও দিন অস্বীকার করতে পারেননি। তাই, অনেক ‘কিন্তু’ থাকলেও শেষমেশ তাঁরা মমতার নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এখন সেই মাপের নেতা কি কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলে এখনও দেখা যাচ্ছে?
সে জন্যই রামধনু জোটের প্রয়োজনীয়তা আজ ফের প্রাসঙ্গিক। অন্তত প্রক্রিয়াটা শুরু হোক। যদি দেখা যায়, পরিবর্তনের পরিবর্তন করা সত্যিই এক ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে ক্ষেত্রে সেই শক্তিই প্রয়োজনে তার নেতা বা নেত্রী খুঁজে নেবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy