Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সাঁওতালি ভাষা শুনে স্যার বলছেন, কী যে বলিস ছাই

হাতলভাঙা চেয়ারে পা দু’টো কাঁচির মতো ভাঁজ করে বসে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ‘স্যার’ কী রে পড়া করে এসেছিস তো সব? বিবর্ণ ঘাসের উপরে হাঁটু মুড়ে গুটিসুটি বসে থাকা ক্লাস ওয়ান তড়াক করে উঠে শুরু করে ‘জেঁড়ে ক ক তের তের...’ (তর্জমায় যা দাঁড়ায়, পাখি সব করে রব)।

রাহুল রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

হাতলভাঙা চেয়ারে পা দু’টো কাঁচির মতো ভাঁজ করে বসে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ‘স্যার’

কী রে পড়া করে এসেছিস তো সব?

বিবর্ণ ঘাসের উপরে হাঁটু মুড়ে গুটিসুটি বসে থাকা ক্লাস ওয়ান তড়াক করে উঠে শুরু করে

‘জেঁড়ে ক ক তের তের...’ (তর্জমায় যা দাঁড়ায়, পাখি সব করে রব)।

ছোট্ট ছেলেটার পাঠ খানিক শুনে মাথা হেঁট শিক্ষক হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেন, ‘তোরা কী যে বলিস...বুঝিও না ছাই!’

ইতস্তত করে বসে পড়ে ছেলেটি। তেঁতুল-ছায়ায় অড়লফুলঝোড়ের সেই উন্মুক্ত ক্লাসে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে জনা বাইশ ছাত্রের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে পাল্টা এক প্রশ্ন‘চেত হ বাং বুঝাও দাড়ি কানা স্যার...’ (আপনি যে কী বলেন স্যার আমরাও কিছু বুঝতে পারি না)।

দু’টি না-বোঝা ভাষার মাঝে পড়ে থাকে বাঁকুড়ার সেই প্রান্তিক গ্রামের প্রাথমিক স্কুলটি। যেখানে ছাত্রেরা ভিড় করে, শিক্ষকও। কিন্তু কেউ কারও ভাষার চৌকাঠ ডিঙোতে পারেন না। খানিক সময় কাটিয়ে ফিরে যান শিক্ষক। হইহই করে ছুটি হয়ে যায় অড়লফুলঝোড়ের স্কুল।

বারিকুল ব্লকের ওই আদিবাসী স্কুলটি নেহাতই একটা উদাহরণ। সাঁওতালি মাধ্যমের এমনই ১০৬টি স্কুল রয়েছে বাঁকুড়া জেলায়। জঙ্গলমহলের অন্য দুই জেলা, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে সংখ্যাটা যথাক্রমে ১৭ এবং ৫২। যেখানে ‘অচেনা’ ভাষায় বিব্রত শিক্ষক খোলাখুলিই বলছেন, “সাঁওতালি ভাষাটাই ভাল করে রপ্ত হয়নি। ছেলেমেয়েদের পড়াব কী করে?”

ভাষা দিবসের মুখে, সাঁওতালি না-জানা ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে যার প্রতিকার চেয়েছে রাজ্যের সাঁওতালি ভাষা শিক্ষা অধিকার মঞ্চ-সহ এগারোটি আদিবাসী সংগঠন। মঞ্চের নেতা সনগিরি হেমব্রমের কটাক্ষ, “ভাষা দিবস নিয়ে সরকারের মাতামাতির অন্ত নেই। অথচ দেখুন, সরকার অনুমোদিত সাঁওতালি মাধ্যমের স্কুলগুলিতেই নিজের ভাষায় কথা বলতে পারছে না আদিবাসী ছাত্রেরা।” নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, আদিবাসী সংগঠনগুলির উষ্মায় কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষা দফতরের কর্তাদের এ ব্যাপারে খোঁজখবরও নিতে বলেছেন তিনি।

কিন্তু প্রশ্ন হল, জঙ্গলমহলের ওই স্কুলগুলিতে সাঁওতালি না-জানা শিক্ষকদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হল কী করে?

নিয়োগের পরে ‘কিছু অসুবিধার’ কথা কানে এসেছে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্যের। তিনি অবশ্য ভরসা জোগাচ্ছেন “যা সমস্যা রয়েছে তা অল্প দিনেই মিটে যাবে।” তবে ওই নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু ‘ভুল’ যে হয়েছে, মেনে নিচ্ছেন রাজ্য মন্ত্রিসভায় আদিবাসী সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি সুকুমার হাঁসদা। তিনি বলেন, “আদিবাসী সমাজের কাছে এটা এক ধরনের প্রতারণা তো বটেই।” নয়াগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক দুলাল মুর্মুও ক্ষুব্ধ, “সাঁওতালি মাধ্যমের স্কুলে ছেলেমেয়েরা নিজের ভাষায় কথা বলতে পারছে না এটা ঘোর দুঃখজনক।”

পালাবদলের পরে, জঙ্গলমহলে ‘হাসি’ ফোটাতে ২০১১ সালে ঝাড়গ্রামের সভায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, পুলিশের পরে সাঁওতালি ভাষার শিক্ষকও নিয়োগ হবে জঙ্গলমহলে। পদের সংখ্যা ১৮০০। শুধু আদিবাসীরাই নন ওই পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন সকলেই। শর্ত ছিল একটাই, জঙ্গলমহলের বাসিন্দা ওই প্রার্থীকে অলচিকি হরফ এবং সাঁওতালি ভাষায় সড়গড় হতে হবে। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, গত আড়াই বছরে বাঁকুড়া জেলায় চুক্তির ভিত্তিতে পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে ৩৪৯ জন। যাঁদের মধ্যে মাত্র ২১ জন আদিবাসী এবং সাঁওতালি ভাষাটা জানেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৪৪৮। যার মধ্যে আদিবাসীর সংখ্যা মাত্র ৩৫ এবং পুরুলিয়ার ২২৩ জন পার্শ্বশিক্ষকের মধ্যে সাকুল্যে ৪৭ জন আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। বাকিরা নিতান্তই বাঙালি, যাঁরা সাঁওতালি ভাষার বিন্দুবিসর্গ জানেন না বলে অভিযোগ।

বাঁকুড়ার রানিবাঁধের একটি প্রাথমিক স্কুলে সদ্য নিয়োগপত্র পাওয়া এমনই এক শিক্ষিকা মেনে নিচ্ছেন, “জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায় নিয়োগপত্রও পেয়েছি। ভেবেছিলাম বাংলাতে পড়ালেও আদিবাসী ছেলেমেয়েরা অসুবিধা হবে না। এখন দেখছি ব্যাপারটা অসম্ভব।”

বাম জমানায় রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী ছিলেন উপেন কিস্কু। তাঁর অভিযোগ, “সাঁওতালি ভাষায় জ্ঞান নয়, ওই নিয়োগের ক্ষেত্রে মাপকাঠি ছিল প্রার্থীরা কতটা শাসক দলের ঘনিষ্ঠ।” আদিবাসী সংগঠন ‘আসেকা’র সম্পাদক দুঃখীরাম হাঁসদার আক্ষেপ, “ভাষা দিবসে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না আদিবাসী পড়ুয়ারা। এর চেয়ে বড় অপমান কিছু হয়?”

সম্ভবত, এ প্রশ্নের কোনও উত্তরও হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE