বিরোধী শিবিরে থাকলে যা ভাল, শাসক হলে তা-ই খারাপ! সিঙ্গুরে যা ঠিক, অণ্ডালে তা-ই অন্যায়! জমি প্রশ্নে তৃণমূলের এমন দ্বৈত ভূমিকাই ফের স্পষ্ট হয়ে গেল শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের ভোলবদলে!
অন্ডাল বিমাননগরীর অনিচ্ছুক জমিদাতাদের আন্দোলনকে নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বুধবার মলয়বাবু বলেছিলেন, জমি এক বার অধিগ্রহণ করা হলে আর ফেরত দেওয়ার আইনি সংস্থান নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছিল, তা হলে সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমির জন্যও তো একই যুক্তি প্রযোজ্য! সেখানে তবে তৃণমূলের আন্দোলন হল কী ভাবে? প্রবল অস্বস্তির মধ্যে পড়ে এবং তৃণমূল নেতৃত্বের নির্দেশে বৃহস্পতিবার মলয়বাবু দাবি করেছেন, “বিভিন্ন সংবাদপত্রে আমার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে।” যদিও শ্রমমন্ত্রীর মন্তব্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমে রেকর্ড হয়েছে এবং সেখানে অপব্যাখ্যার অবকাশ নেই!
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, শ্রমমন্ত্রী তাঁর মন্তব্যের যে লিখিত ও মৌখিক ব্যাখ্যা এ দিন দিয়েছেন, তাতে জমি অধিগ্রহণের আইনি সংস্থান নিয়ে কিছু বলা হয়নি। মলয়বাবুর লিখিত বিবৃতির মূল কথা, ‘অন্ডালের আন্দোলনের সঙ্গে সিঙ্গুরের তুলনা করে সিঙ্গুরকে ছোট করার চেষ্টা হয়েছে। সিঙ্গুরের চাষিদের স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীর ২৬ দিন অনশন অবস্থান সারা বিশ্বে স্বীকৃত।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘অন্ডালের আন্দোলন এক নয়। এখানে চাষ হয় না, হলেও একফসলি। জমির মালিকেরা কেউই অনিচ্ছুক নন। তাঁরা বর্ধিত দাম চাইছেন, জমি দিতে তাঁরা রাজি।’ অর্থাৎ তাঁদের আপত্তি সিঙ্গুরের সঙ্গে অন্ডালের তুলনা টানা নিয়ে! সিঙ্গুরের আন্দোলনের মুখ্য চরিত্র ছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর অণ্ডালে অনিচ্ছুক জমির মালিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিজেপি। তুলনাতে তাই অধুনা শাসক দলের অস্বস্তি!
ঘটনা হল, সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমি মমতার সরকার আবার অনিচ্ছুক কৃষকদের ফেরত দিতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন এখন সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন। নভেম্বরের ১৯-২০ তারিখের মধ্যে চূড়ান্ত রায় হওয়ার কথা। তার আগে জমি আইনত ফেরানো যায় না, এই কথা বলা মানে সিঙ্গুরের মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনিতেই দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ক্লান্ত ও ক্ষুব্ধ সিঙ্গুরের মানুষ মনে করে নিতে পারেন, রাজ্য সরকার হয়তো বুঝতে পারছে আদালতে তাদের জয়ের আশা কম। সেই জন্যই তড়িঘড়ি আসরে নেমেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব এবং তাতে নিজেদের বিড়ম্বনাই আরও প্রকট হয়েছে! এমনকী, পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সিঙ্গুরের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ফের টাটার উদ্দেশে আবেদনও জানাতে হয়েছে তাঁদের।
তৃণমূলের মহাসচিব এবং রাজ্যের আর এক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, “যেখানেই যা হোক না কেন, এখানে টাটাদের বিনিয়োগকে আমরা স্বাগত জানাই। টাটারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বহু কাজ করেছেন। তাই আমাদের আবেদন, সমস্ত কিছু ভুলে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরতের ব্যাপারে টাটারা উদ্যোগী হবেন।” সিঙ্গুরের কৃষকদের আশ্বস্ত করতেই মলয়বাবুর মন্তব্য অপব্যাখ্যার তত্ত্ব এবং পার্থবাবুর টাটাদের প্রতি আবেদন।
মলয়বাবু এ দিন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সিঙ্গুর এবং অন্ডালের জমি বাম আমলে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে বাম সরকার চাষযোগ্য জমি অধিগ্রহণ করেছিল। যে কারণে তৃণমূল নেত্রী অনশন করেছিলেন এবং ক্ষমতায় এসে জমি ফেরত দেওয়ার জন্য আইন পর্যন্ত করেছেন। অন্ডালের জমিতে গত ২০ বছরে চাষ হয়নি। হলেও এক ফসলি জমি। অন্ডালে জমি মালিকেরা বেশি টাকা চাইছেন। দু’টো আন্দোলন একেবারেই আলাদা। শ্রমমন্ত্রী কিন্তু জমি অধিগ্রহণ নিয়ে এ দিন একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি! এক বার জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেলে তা আর ফেরত দেওয়া যায় কি না, বারবার সেই প্রশ্নের উত্তর এ দিন এড়িয়ে গিয়েছেন সুকৌশলে!
শ্রমমন্ত্রীর আগের দিনের মন্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “মলয়বাবু আইনমন্ত্রী থাকাকালীনই কিন্তু সিঙ্গুরে জমি ফেরানোর জন্য আইন সংশোধন করা হয়েছিল। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। অর্থাৎ সেটা এখনও নাকচ হয়নি।” শ্রমমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে দাবি করে পার্থবাবুও বলেছেন, “সিঙ্গুরের আন্দোলন ঐতিহাসিক। সেখানে বহুফসলি জমি বাঁচাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মানুষের আন্দোলন ভাঙতে বোমা, গুলি ও পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্ডালে জমির দর বাড়াতে আন্দোলন হচ্ছে। সিঙ্গুরে দর-বৃদ্ধির আন্দোলন হয়নি!”
তৃণমূলের এমন ভূমিকা দেখে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না সিপিএম। সিঙ্গুর-পর্বে বাম সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন বারবারই বলতেন, অধিগৃহীত জমি ফেরানোর সংস্থান চলতি আইনে নেই। আর এ দিন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “মলয় ঘটককে চাকরি বাঁচাতে হবে, তাই এখন এ সব বলছেন। ওঁরা চির কালই দ্বিচারিতা, দোটানার মধ্যে থাকেন! সিঙ্গুর, কাটোয়া, অন্ডাল এগুলো পাশাপাশি রাখলেই সব বোঝা যাবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy