সুচেতার বাড়িতে ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য আনা হল সমরেশ সরকারকে। মঙ্গলবার দুর্গাপুরে। ছবি: বিকাশ মশান
বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম, নাকি টাকার লোভ— সুচেতা খুনের পিছনে ‘মোটিভ’ সম্পর্কে ক্রমে ধন্দ বাড়ছে পুলিশের।
প্রথম দিকে তদন্তকারীরা এক রকম নিশ্চিত ছিলেন, বিয়ের জন্য নাছোড় প্রেমিকাকে জীবন থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতেই সুচেতা ও তাঁর শিশুকন্যাকে খুন করেছেন সমরেশ সরকার। দু’জনের দেহ লোপাট করতে টুকরো টুকরো করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তদন্তে পাওয়া তথ্য থেকে পুলিশের ধারণা, সুচেতার টাকা ও গয়নার দিকেও নজর ছিল সমরেশের। সুচেতার অনুপস্থিতিতে সে সব হাতিয়ে নেওয়ার ছক কষেছিলেন তিনি। সুচেতার পারিবারিক সূত্র এবং সমরেশবাবুর কর্মস্থল থেকে পাওয়া নানা সূত্র থেকে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অর্থের লোভের অভিযোগ ক্রমে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
তদন্তকারীরা জানান, দুর্গাপুরের মামড়াবাজারের যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সমরেশবাবু, সেখানকার সেভিংস আমানতে সুচেতার চার হাজার টাকার কিছু বেশি রয়েছে। কিন্তু ওই ব্যাঙ্কেই তাঁর একটি ১ লক্ষ টাকার ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ রয়েছে। ১৩ এপ্রিল সেটি করা হয়েছে। সেখানে ‘নমিনি’ হিসেবে নাম রয়েছে সমরেশবাবুর মা পুতুলরানি সরকারের। যার অর্থ, সুচেতার কিছু হয়ে গেলে সেই টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ ছিল সমরেশের। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ফিক্সড ডিপোজিট ছিল সুচেতার, যেগুলির মোট টাকার পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ টাকা। সেগুলিতে কোনও ‘নমিনি’ রাখাই হয়নি। তদন্তকারীদের ধারণা, সুচেতার অবর্তমানে সেই টাকাও সমরেশের পক্ষে সরিয়ে ফেলার সুযোগ ছিল।
কেবল সুচেতা নয়। জেরায় দ্বিতীয় এক তরুণীর নাম সমরেশ জানিয়েছে, যার আট লক্ষ টাকার মাসিক সঞ্চয় প্রকল্পের কাগজপত্র সমরেশের কাছেই রয়েছে। ওই তরুণীর বাবা এক সময়ে সমরেশবাবুর সহকর্মী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে মা ও মেয়েকে দুর্গাপুরে ভাড়া বাড়ি দেখে দেন সমরেশই। তাঁর ওই পরিবারে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এমনকী, ওই তরুণীর সঙ্গে সমরেশবাবুকে বাইরেও একসঙ্গে দেখা গিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি।
তদন্তকারীদের ধারণা, দেখাশোনার নাম করে ওই পরিবারের আর্থিক দিক-সহ সবটাই কুক্ষিগত করে নিচ্ছিলেন সমরেশ। অন্তত ওই তরুণীর বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তিনি যে নিজের স্বার্থ গুছিয়েছেন, তার ইঙ্গিত মিলেছে। কারণ ২০১৪-র জুলাইয়ে সমরেশ ওই তরুণীকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা দিয়ে ওই অঙ্কেরই ‘চেক’ লিখিয়ে নেন। তদন্তকারীদের ধারণা, সেই টাকা তিনি তাঁর বৈধ অ্যাকাউন্টে দেখাতে চাননি। তাই ‘বাঁকা’ পথ নেন। সেই টাকার উৎস কী, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
ওই তরুণীর সঙ্গে মঙ্গলবার ফোনে কথা বলে শ্রীরামপুর থানার পুলিশ। পুলিশ সূত্রের খবর, সমরেশের হাতে আর্থিক কাগজ থাকার কথা স্বীকার করলেও তাঁর সঙ্গে ‘অন্য’ কোনও সম্পর্কের কথা মানতে চাননি ওই তরুণী। যদিও অভিভাবকহীন মহিলাদের সাহায্যের ভান করে তাঁদের নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করা প্রায় অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন সমরেশ, এমনই মনে করছে পুলিশ।
তবে সুচেতার সম্পত্তির কতটা হস্তগত করেছেন সমরেশবাবু, তার উত্তর মিলতে পারে সুচেতার ব্যাঙ্ক লকার থেকে। তদন্তকারীরা সুচেতার পারিবারিক সূত্রে জেনেছেন, ব্যাঙ্কের লকারে আনুমানিক ৫০ ভরি সোনার গয়না রেখেছিলেন সুচেতা। সুচেতার মেজোমামা প্রভাত পাঠক বলেন, ‘‘তদন্তে যা পাওয়া গিয়েছে বলে পুলিশের কাছে শুনছি, তাতে আমাদের আশঙ্কা সুচেতার লকারে কিছু নেই।’’
ব্যাঙ্কের নথি অনুযায়ী সুচেতার লকার শেষ খোলা হয় ১০ জুলাই। অথচ ব্যাঙ্কেরই এক কর্মী জোরের সঙ্গে জানিয়েছেন, ২৪ অগস্ট সুচেতাকে সঙ্গে নিয়ে লকার খুলেছিলেন সমরেশ। কিন্তু ব্যাঙ্কের খাতায় সে দিন সই করেননি সুচেতা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ব্যাঙ্কের ‘লকার রুম’ এর সিসিটিভি ফুটেজ মঙ্গলবার বিকেলে সংগ্রহ করা হয়েছে। তা পরীক্ষা করে দেখা হবে।
সহ-প্রতিবেদন: সীমান্ত মৈত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy