সশস্ত্র বহিরাগত থেকে মাওবাদী। মাওবাদী থেকে ছোট ঘটনা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের পরিচিত লব্জগুলোর সব ক’টাই এ বার ব্যবহার হয়ে গেল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায়।
আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের হাতে তাঁর প্রাণসংশয় হয়েছে দাবি করে মঙ্গলবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডেকেছিলেন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। বৃহস্পতিবার লালবাজারে পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ উপাচার্যের দাবিকে কার্যত মান্যতা দিয়ে ‘সশস্ত্র বহিরাগতে’র তত্ত্ব হাজির করেছেন। আবার প্রশাসন সূত্রেরই খবর, যাদবপুরের ঘটনা নিয়ে কমিশনার নবান্নে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, তাতে মাওবাদী নেতাদের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে।
পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ পর্যন্ত যাদবপুরের ঘটনা নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি। তবে এ দিন পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠকে তিনি নানা কথার মাঝে বলে ওঠেন, “এখন ছোট ঘটনা ঘটলেও বড় করে দেখানো হয়। তিলকে তাল করা হয়।” এর আগে মুখ্যমন্ত্রীর বলা নানা ‘ছোট ঘটনা’র পরম্পরা মাথায় রেখে বিরোধীদের একাংশ মনে করছেন, এ দিন পরোক্ষে যাদবপুরের কথাই বুঝিয়েছেন মমতা।
যদিও খোদ পুলিশ কমিশনার যেখানে ‘সশস্ত্র বহিরাগত’ এবং ‘মাওবাদী’ উপস্থিতির কথা বলেছেন, সেটা ‘ছোট ঘটনা’ হয় কী করে এ প্রশ্ন উঠেছে। তবে কি পুলিশই তিলকে তাল করে দেখাচ্ছে? যাদবপুরের ছাত্র-শিক্ষকদের একাংশ এই প্রশ্ন তুলছেন। আবার লাঠিচার্জের অভিযোগ খারিজ করতে গিয়ে সিপি-র দাবি, পুলিশ সে দিন লাঠি নিয়ে যায়নি। তা হলে সশস্ত্র বহিরাগতদের মোকাবিলায় নিরস্ত্র পুলিশ কেন পাঠানো হল? এই স্ববিরোধের উত্তর সিপি-র কথায় মেলেনি।
এ দিন লালবাজারে সাংবাদিকদের ঠিক কী বলেছেন সুরজিৎবাবু? তাঁর বক্তব্য, মঙ্গলবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ও বাইরে বেশ কিছু বহিরাগত লোকজন জড়ো হন। তাঁদের কাছে ‘মারাত্মক অস্ত্র’ও ছিল।
কিন্তু ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরেও পুলিশ কেন ওই বহিরাগতদের পরিচয় জানতে পারল না? কেন-ই বা অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করা এক জনকেও গ্রেফতার করা গেল না? কেন আটক করা হল না অস্ত্র? এর জবাব অবশ্য পুলিশ কমিশনার দেননি। তিনি শুধু বলেন, “অল্প সময়ের মধ্যেই কারা বহিরাগত ছিল, সেটাও আমরা জেনে যাব। কিছু ক্যামেরার ছবি বের করার চেষ্টা করছি, যদি পাই আপনাদের জানাব।”
মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে আলো নিভিয়ে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। সমালোচনার ঝড় বইছে সর্বত্র। এই অবস্থায় এ দিন সিপি কী বলেন, স্বাভাবিক ভাবেই তা নিয়ে আগ্রহ ছিল বিভিন্ন মহলে। কিন্তু পুলিশের একাংশই কবুল করছেন, সিপি-র বক্তব্য এ দিন গেরো সামাল দিতে তো পারেইনি, বরং নতুন করে বিতর্ক তুলে দিয়েছে।
পুলিশেরই একাংশ এর সঙ্গে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের পরপর তৎকালীন সিপি রঞ্জিত পচনন্দার সাংবাদিক বৈঠকের কিছুটা মিল খুঁজে পাচ্ছেন। পার্ক স্ট্রিট মামলায় পুলিশের একাংশের গাফিলতি নিয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ায় সাংবাদিক বৈঠক ডেকে রঞ্জিতবাবু বলেছিলেন, “প্রশাসন ও সরকারকে কালিমালিপ্ত করতেই
এ সব বলা হচ্ছে।” এ দিন অবশ্য তেমন কিছু বলেননি সুরজিৎবাবু। তবে উপাচার্য এবং রাজ্য প্রশাসনের সুরে সুর মিলিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীদেরই আক্রমণকারীর তকমা দিয়েছেন। এবং পুলিশ কাউকে মারধর করেনি বলে দাবি করে পুলিশের ধৈর্য এবং সংবেদনশীলতার প্রশংসা করেছেন। তবে এই সাংবাদিক বৈঠক নিয়ে তিনি নিজে যে কিছুটা বিব্রত, সেটা অবশ্য হাবেভাবেই বোঝা যাচ্ছিল।
এ দিন বেলা দেড়টা নাগাদ সাংবাদিক বৈঠকে হাজির হন কলকাতার পুলিশ কমিশনার। সাংবাদিকদের প্রথমে দেখানো হয় পুলিশের তোলা একটি ভিডিও ফুটেজ। পুলিশের ছাত্র পেটানোর অংশ ওই ফুটেজে নেই। তাতে দেখানো হয়েছে, পড়ুয়ারাই গোলমাল করছেন। এই ফুটেজের ভিত্তিতেই কমিশনার প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, পুলিশ কোনও বাড়াবাড়ি করেনি।
সিপি-র দাবি, “উপাচার্য নিজে লিখিত ভাবে জানান, এবং তার পরে বারবার পুলিশকে বলতে থাকেন যে ওঁদের প্রাণসংশয় হতে পারে। সেই কারণে পুলিশ ওখানে যায়।” বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনও শিক্ষকের মুখে অবশ্য প্রাণ সংশয়ের কথা শোনা যায়নি। উল্টে সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত এ দিন জানান, এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই উপাচার্য পুলিশ ডেকেছিলেন। ফলে এ সিদ্ধান্ত তাঁর একতরফা ছিল। পুলিশ কমিশনার বলেন, “আমাদের কাছে এটাও রিপোর্টেড হচ্ছিল যে, কিছু বহিরাগত ওখানে ছিলেন। তাঁদের হাতে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। পুরো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুুলিশকে বলা হয় উপাচার্য এবং অন্য যে অধ্যাপক-অধ্যাপিকা-কর্মীরা আটকে রয়েছেন, তাঁদেরকে বের করে আনতে।”
এর পরই লাঠিচার্জ এবং মারধরের অভিযোগ উড়িয়ে দেন সিপি। বলেন, “আমি জোর দিয়ে বলছি, পুলিশকে বলা হয়েছিল, লাঠি নিয়ে ওখানে প্রবেশ না করতে। পুলিশ যাঁরাই ওখানে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অধিক সংখ্যক সাদা পোশাকে ছিলেন, এবং তাঁদের কারও হাতে লাঠি ছিল না। লাঠিচার্জের ঘটনা একেবারেই অসত্য এবং লাঠিচার্জ হয়নি।”
ক্যামেরায় অবশ্য ধরা পড়েছে, সেই রাতে সাদা পোশাকের পুলিশ ও কমব্যাট বাহিনীর জওয়ানরা পড়ুয়াদের লাথি-ঘুঁষি মারছেন। লাঠিও চালানো হচ্ছে। যদিও সিপি-র দাবি, পুলিশ হেনস্থা করেছে বা লাঠিচার্জ করেছে বলে ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়েনি। এ দিন সিপি-কে প্রশ্ন করা হয়, তিনি পুলিশের আচরণের বিরুদ্ধে তদন্ত করার নির্দেশ পেয়েছেন কি না। সিপি উত্তরে বলেন, এখনও পর্যন্ত ফোর্সের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ পাননি। বরং, “উপাচার্য এবং আরও কয়েক জন মহিলা অধ্যাপককে উদ্ধার করার সময় যথেষ্ট সংবেদনশীলতার সঙ্গেই কাজ করেছে পুলিশ। ছাত্রছাত্রীরাই পুলিশকে আক্রমণ করেছে।”
ঠিক এ কথাই বুধবার বলেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। এ দিন শিক্ষামন্ত্রী ফের বলেন, “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনের ইতিহাস আছে। সে পরিস্থিতি আর আসতে দেওয়া যায় না। পুলিশ তাদের কর্তব্য করেছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy